গাজায় পুনর্গঠন ও প্রশাসনের জন্য আরব বিশ্বের পরিকল্পনা: দ্বিধা বিভক্ত ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের বিরোধিতা।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা পুনর্গঠন এবং সেখানকার প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করানোর জন্য মিশরের প্রস্তাব এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭ই অক্টোবর, ২০২৩-এর সংকট-পরবর্তী সময়ে আরব রাষ্ট্রগুলো, অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) এবং কিছু ইউরোপীয় দেশ এই পরিকল্পনার সমর্থন জুগিয়েছে।
একে নিছক মানবিক সহায়তা হিসেবে দেখলে ভুল হবে, বরং এটি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক কৌশল। এর মূল লক্ষ্য হলো, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনপুষ্ট গাজা উপত্যকা জনশূন্য করার চক্রান্তকে প্রতিরোধ করা।
দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রহীনতার মূল বিষয়টি সমাধান না করে গাজা পুনর্গঠন ও শাসনের দায়িত্ব নিতে দ্বিধা বোধ করছিল আরব দেশগুলো। তারা কার্যত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) ২.০ সংস্করণে পরিণত হতে চাচ্ছিল না।
কারণ, সেক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের দায়ভার তাদের ওপর বর্তাতো। কিন্তু ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর গাজা বিষয়ক পরিকল্পনার কারণে তারা এখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই উদ্যোগে শামিল হতে চাইছে।
মিশরের প্রস্তাবিত ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পুনর্গঠন পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে একটি স্থানীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন, যা প্রথম ছয় মাস টেকনোক্র্যাটদের দ্বারা পরিচালিত হবে। এরপর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা রয়েছে।
তবে এই পদ্ধতিগত কিছু সমস্যা রয়েছে, যা বাস্তবায়নের আগেই পরিকল্পনাটিকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) কোনো ভূমিকা গ্রহণে তীব্র বিরোধিতা করছেন। তার এই অবস্থানের পেছনে রয়েছে একটি কৌশল।
তিনি মনে করেন, গাজায় পিএকে দায়িত্ব দিলে গাজা ও পশ্চিম তীরের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যের সম্ভাবনা তৈরি হবে, যা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের আলোচনার পথ খুলে দেবে।
দশকের পর দশক ধরে নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলের রাজনৈতিক মহল এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে দিতে চায়নি, যা ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দিকে নিয়ে যায়। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বিভাজন ও খণ্ড-বিখণ্ড অবস্থাই তাদের স্বার্থ রক্ষা করে।
এর ফলে রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য সবসময় অধরাই থেকে যায়।
নেতানিয়াহুকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে হলে আরব রাষ্ট্রগুলোকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষের সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন জরুরি।
কারণ, তাদের ক্ষমতা আছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে এই পরিকল্পনা মেনে নিতে বাধ্য করার।
নেতানিয়াহু হয়তো এখনো প্রশাসনিক জটিলতা, সামরিক উত্তেজনা বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে পরিকল্পনাটিকে বানচাল করার চেষ্টা করতে পারেন। তবে গাজায় নতুন করে যুদ্ধ এবং দীর্ঘমেয়াদি অবরোধের মাধ্যমে জাতিগত নিধন প্রতিরোধের জন্য আরব পরিকল্পনা এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো বিকল্প।
ইসরায়েলের প্রতিরোধের বাইরে, আরব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরেকটি বড় বাধা হলো ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ)। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে এটি বর্তমানে একটি অজনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
অসলো চুক্তির পতনের পর এর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাও হ্রাস পেয়েছে।
আব্বাস দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন, স্বৈরাচারী শাসনকে শক্তিশালী করেছেন এবং ২০০৬ সাল থেকে কোনো নির্বাচন দেননি।
এর মাধ্যমে তিনি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের বৈধতাকে দুর্বল করেছেন। বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক সংস্কার প্রচেষ্টা এবং ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যেকোনো প্রতিরোধকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করাই তার শাসনের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোনো কার্যকর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া না থাকার কারণে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলি দখলদারিত্বের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। পশ্চিম তীরে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করলেও, স্বাধীন সত্তা হিসেবে শাসন করার মতো কোনো ক্ষমতা তাদের নেই।
এর ফলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। আব্বাসের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ক্রমবর্ধমান কঠোর পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে, বিশেষ করে ইসরায়েলি জাতিগত নিধনের নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার কর্মী ও দলগুলোর ওপর দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে।
গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের গণহত্যা চালানোর গত ১৬ মাসে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা বিশেষভাবে চোখে পড়েছে। আব্বাস ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে কার্যত নীরব ছিলেন, যা তার অকার্যকারিতা প্রমাণ করে।
আব্বাসের সরকার শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের আস্থা হারায়নি, বরং ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও আরব রাষ্ট্রসহ বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
আব্বাস ইসরায়েল ও আন্তর্জাতিক দাতাদের ওপর নির্ভরশীল। তাদের কাছ থেকে কর্তৃপক্ষের জন্য সহায়তা পেতে গিয়ে তিনি জনগণের চাহিদার চেয়ে তাদের দাবিকে বেশি গুরুত্ব দেন, যা প্রায়ই জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী।
ফলে দেশে তার জনপ্রিয়তা কমেছে এবং স্বৈরাচারী মনোভাব বেড়েছে।
সম্প্রতি তিনি পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়ন শুরু করেছেন এবং ইসরায়েলের হাতে নিহত, আহত বা কারারুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছেন।
ফিলিস্তিনি জনগণ ও তাদের নেতৃত্বের মধ্যেকার এই দীর্ঘদিনের সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার মাধ্যমে আব্বাস প্রমাণ করেছেন যে তিনি ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্বের সন্তুষ্টির জন্য কতটা মরিয়া।
গাজায় ফিলিস্তিনি শাসনের জরুরি প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় আরব রাষ্ট্রগুলো এখন এমন একজন নির্ভরযোগ্য সহযোগী খুঁজছে, যার ওপর আস্থা রাখা যায়। কিন্তু বিদ্যমান ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং সম্ভবত গাজার কার্যকর প্রশাসন চালাতে অক্ষম।
আরব বিশ্বের কিছু অংশ, সেইসাথে ফিলিস্তিনি সুশীল সমাজ এবং প্রবাসীরা নতুন নেতৃত্ব চাইছে। তবে আব্বাস ও তার অনুগতরা এই ধরনের যেকোনো প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করছেন।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে, দোহায় অনুষ্ঠিতব্য ফিলিস্তিনি জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিতে আসা ৩৩ জন প্রতিনিধিকে পশ্চিম তীর ছাড়তে বাধা দেওয়া হয়।
এই সম্মেলনটি ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি গণ-প্রচেষ্টা হিসেবে পরিচিত ছিল।
একই সময়ে, আরব সরকারগুলোর বিরোধিতার বিষয়টি বিবেচনা করে আব্বাস ফাতাহ আন্দোলনের কিছু অসন্তুষ্ট সদস্যকে, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত-সমর্থিত তার প্রতিদ্বন্দ্বী মোহাম্মদ দাহলানকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন।
দাহলান বর্তমানে আবুধাবিতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন।
দাহলানের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের গতিশীলতায় পরিবর্তন আনতে পারে, তবে এটি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) মূল সংকট, অর্থাৎ বৈধতার অভাব, দূর করতে পারবে না।
শীর্ষ পর্যায়ে রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস কোনো পদ্ধতিগত সংস্কার নয়। জাতীয় ঐক্য এবং প্রতিনিধিত্বমূলক পুনর্গঠনের প্রতি বৃহত্তর অঙ্গীকার ছাড়া, নতুন নেতৃত্বের কাঠামো আব্বাসের শাসনের ব্যর্থতাকে উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করার ঝুঁকিতে থাকবে।
গাজার পুনর্গঠন, ফিলিস্তিনি রাজনীতির ওপর আব্বাসের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে একটি নতুন ফিলিস্তিনি জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। একই সঙ্গে এর পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।
যদি আরব রাষ্ট্রগুলো নেতানিয়াহুর অনমনীয়তা, আব্বাসের আত্মস্বার্থ এবং ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ বিভেদ- এই রাজনৈতিক মাইনফিল্ডগুলো সফলভাবে অতিক্রম করতে পারে, তবে তারা গাজাকে একটি স্থিতিশীল ও স্বায়ত্তশাসিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
অন্যদিকে, আব্বাস এবং তার কর্মকর্তাদের চক্র যদি ক্ষমতায় টিকে থাকে, তবে এই প্রচেষ্টা দ্রুত ব্যর্থ হতে পারে। এর ফলে ইসরায়েলের আধিপত্য এবং ফিলিস্তিনি বিভেদ আরও বাড়বে।
গাজার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। আরব রাষ্ট্রগুলোর এই হস্তক্ষেপ ফিলিস্তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণের দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারে—অথবা এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়াও হতে পারে।
যদি আব্বাস ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখেন, পিএলও একটি অকার্যকর সংগঠনে পরিণত হয় এবং নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে তার চক্রান্ত অব্যাহত রাখেন, তবে আরব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক সংস্কার, সেইসাথে ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন। আরব রাষ্ট্রগুলোর পরিকল্পনা তাদের পথে থাকা কাঠামোগত বাধাগুলো অতিক্রম করতে পারবে কিনা, তা এখনো দেখার বিষয়।
তবে ফিলিস্তিনের নেতৃত্বের সংকট যদি এরই মধ্যে গাজার ভাগ্য নির্ধারণ করে না থাকে, তবে এখনই সময় এসেছে একটি সঠিক পথে ফিরে আসার, অন্যথায় অনেক দেরি হয়ে যাবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা।