সিন্ধু নদীর ব-দ্বীপ: সমুদ্র গ্রাসে বিলীন, খাল খননে নতুন শঙ্কা।
পাকিস্তানের সিন্ধু নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চলের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। একদিকে যেমন সমুদ্রের নোনা জল ক্রমশ গ্রাস করছে এই জনপদকে, তেমনই অন্যদিকে সেচ প্রকল্পের জন্য নতুন করে খাল খননের উদ্যোগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্যেও রয়েছে উদ্বেগের বার্তা।
পাকিস্তানের করাচি শহর থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে সিন্ধু প্রদেশের একটি উপকূলীয় জেলা থাট্টা। সেখানকার খোবার ক্রিকের কাছে অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম দান্ডো জেটি।
এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস হলো মাছ ধরা। কিন্তু গত কয়েক বছরে এখানকার চিত্রটা গেছে পাল্টে।
নদীর জল শুকিয়ে যাওয়ায় এবং সমুদ্রের জল ভেতরে প্রবেশ করায় অনেক গ্রাম ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সেখানকার মানুষজন বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এক সময় খারো চান নামের একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল, যেখানে প্রায় ৪২টি গ্রাম ছিল।
কিন্তু এখন তার মধ্যে মাত্র তিনটি গ্রামের অস্তিত্ব টিকে আছে।
এখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই হয় শহরমুখী হয়েছেন, নয়তো অন্য কোনো গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮৮ সালে খারো চানের জনসংখ্যা ছিল ২৬ হাজারের বেশি, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজারে।
শুধু খারো চান নয়, গত এক দশকে সিন্ধু ব-দ্বীপের বহু গ্রাম সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
আর এখন নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তথাকথিত ‘গ্রিন পাকিস্তান ইনিশিয়েটিভ’। এই প্রকল্পের অধীনে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও বাহরাইন থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
উদ্দেশ্য হলো, প্রায় ১৫ লক্ষ একর অনাবাদী জমিতে চাষাবাদ করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৫ কোটি একর জমির আধুনিকীকরণ করা।
এই প্রকল্পের আওতায় সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও পাঞ্জাব প্রদেশে মোট ৬টি খাল খনন করার কথা রয়েছে।
এর মধ্যে ৫টি খাল তৈরি করা হবে সিন্ধু নদের ওপর, আর ষষ্ঠটি তৈরি হবে শতদ্রু নদীর পাশে।
এই খাল খনন প্রকল্প নিয়ে এরই মধ্যে আপত্তি জানিয়েছে সিন্ধু প্রদেশ সরকার।
তাদের আশঙ্কা, এতে করে পানির অভাবে সিন্ধু প্রদেশ একসময় মরুভূমিতে পরিণত হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের প্রকল্প পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে এবং স্থানীয় মানুষের জীবন আরও কঠিন করে তুলবে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিন্ধু নদের এই ভাঙনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।
ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি করা সেচ ব্যবস্থা এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাঁধ ও খালের নির্মাণ এই অঞ্চলের পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
এক সময় সিন্ধু ব-দ্বীপ ছিল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ব-দ্বীপ, কিন্তু বর্তমানে এর আয়তন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব-দ্বীপ গঠিত হয় বালি, পলি ও জল দ্বারা।
খাল খনন ও বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়, যা ব-দ্বীপ অঞ্চলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
এছাড়া, অতিরিক্ত পানি ব্যবহারের কারণে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়, যা কৃষিকাজের অনুপযোগী করে তোলে।
সিন্ধু ব-দ্বীপ অঞ্চলের এই সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।
আমাদের দেশেও উপকূলীয় অঞ্চলে নদী ভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়ছে।
তাই, পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সুরক্ষার দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা