তুরস্কের সামরিক সক্ষমতা: অস্ত্র রপ্তানিতে দ্রুত উত্থান
সামরিক খাতে তুরস্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়। দেশটি অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানিতে দ্রুত উন্নতি লাভ করেছে।
একসময় যারা অস্ত্রের আমদানিকারক ছিল, তারাই এখন অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে, যা তাদের এই পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে।
সামরিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছে। ১৯৮৫ সালে তারা প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়ন ও সহায়তা প্রশাসন দপ্তর (SAGEB) প্রতিষ্ঠা করে।
শুরুতে এই দপ্তর গবেষণা ও উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর জোর দিলেও, পরবর্তীতে তুরস্ক স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দেয়। এর ফলস্বরূপ, ২০১০-এর দশকে দেশীয় নকশার ওপর ভিত্তি করে সামরিক সরঞ্জাম তৈরি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
বর্তমানে, তুরস্কের হাজার হাজার কোম্পানি স্থল, নৌ ও আকাশ পথের জন্য বিভিন্ন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করছে, যা আন্তর্জাতিক মহলেও স্বীকৃতি লাভ করেছে।
তুরস্কের তৈরি করা অত্যাধুনিক অস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত সম্ভবত ‘বায়রাখতার টিবি-২’ (Bayraktar TB2) ড্রোন। ২০১৪ সালে এটি প্রথমবার ব্যবহার করা হয় এবং বর্তমানে এটি তুরস্কের অন্যতম সফল প্রতিরক্ষা পণ্য হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত।
এছাড়াও, ‘আঙ্কা-এস’ (Anka-S) ও ‘ভেস্টেল কারায়েল’ (Vestel Karayel) এর মতো ড্রোনও তৈরি করা হচ্ছে। তুরস্ক ‘সিলিক কুব্বে’ (Celik Kubbe) নামে একটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করছে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সাহায্যে আকাশে যেকোনো হুমকি শনাক্ত করতে সক্ষম হবে।
এছাড়াও, তারা নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান ‘তুরস্কের কান’ (Turkish KAAN) তৈরির কাজ করছে, যা পুরনো মার্কিন F-16 যুদ্ধবিমানগুলোর স্থলাভিষিক্ত হবে।
স্থলভাগে তুরস্কের সামরিক সক্ষমতার অন্যতম উদাহরণ হলো ‘আলতায়’ (Altay) প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক। এই ট্যাংকটি জার্মানির ‘লেপার্ড’ (Leopard) বা আমেরিকার ‘এব্রামস’ (Abrams)-এর মতো পশ্চিমা মডেলগুলোর সমকক্ষ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
তুরস্কের সামরিক বাহিনী ‘কিরপি’ (Kirpi) নামের মাইন প্রতিরোধী যান এবং আধুনিক পদাতিক যুদ্ধের যান ‘কাপলান’ (Kaplan) ও ‘পার্স’-এর (Pars) মতো সরঞ্জাম ব্যবহার করে।
নৌবাহিনীর জন্য তুরস্ক ‘মিলজেম’ (MILGEM) প্রকল্পের অধীনে অত্যাধুনিক যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করছে। ২০০৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে ‘আদা-শ্রেণির’ করভেট এবং ‘ইস্তাম্বুল-শ্রেণির’ ফ্রিগেট তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়াও উন্নত যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন তৈরির পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে। তুরস্কের নৌবহরের সবচেয়ে বড় জাহাজ হলো ‘টিসিজি আনাদোলু’ (TCG Anadolu), যা ড্রোন বহন করতে সক্ষম এবং ২০২৩ সালে এটি নৌবহরে যুক্ত হয়েছে।
সামরিক সরঞ্জামের পাশাপাশি, তুরস্ক স্মার্ট গোলাবারুদ, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। এর মধ্যে ‘বোরা’ (Bora) স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘আতমাকা’ (Atmaca) দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উল্লেখযোগ্য।
তুরস্কের সামরিক সক্ষমতা অর্জনের পেছনে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় কারণই বিদ্যমান। ১৯৭০-এর দশকে সাইপ্রাসে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছিল দেশটি।
১৯৯০-এর দশকে জার্মানিও তুরস্কের কাছে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এছাড়াও, ২০২০ সালে রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয় তুরস্ক।
তবে এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, তুরস্ক একটি শক্তিশালী অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
বর্তমানে, তুরস্কে প্রায় ৩ হাজার অস্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানি রয়েছে। স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তুরস্কের অস্ত্র রপ্তানি বিশ্ব বাজারের ১.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং তারা বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ১১তম স্থানে রয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, গত বছর তুরস্কের অস্ত্র রপ্তানি ১৭৮টি দেশে পৌঁছেছে, যা ২০১৫-২০১৯ সালের তুলনায় ১০৩ শতাংশ বেশি। তুরস্কের প্রধান ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান ও কাতার।
বায়রাখতার ড্রোন অন্তত ৩১টি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে, যার মধ্যে ইরাক, ইউক্রেন, কেনিয়া, বাংলাদেশ ও জাপানের মতো দেশগুলোও রয়েছে।
সামরিক খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে তুরস্ক কাজ করছে। সম্প্রতি, বায়রাখতার ড্রোনের প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘বায়কার’ (Baykar) তাদের নিজস্ব জেট ইঞ্জিন তৈরির জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
তারা ‘আকিনচি’ (Akinci) ড্রোনের জন্য অভ্যন্তরীণ ইঞ্জিন এবং ‘কাইজিলএমা’ (Kizilelma) নামের মনুষ্যবিহীন যুদ্ধ বিমানের জন্য টার্বোফ্যান ইঞ্জিন তৈরি করতে চায়।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা