গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (ডিআরসি) : খনিজ সম্পদের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহায়তা চাইছে।
গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (ডিআরসি) বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা সহায়তা চেয়ে দৈনিক আলোচনা চালাচ্ছেন, যার বিনিময়ে কঙ্গোর খনিজ সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এমন প্রস্তাবনা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
ডিআরসিতে বর্তমানে সশস্ত্র গোষ্ঠী এম২৩-এর দৌরাত্ম্য বাড়ছে, যা দেশটির পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত স্বর্ণ ও কলটান (যা ইলেকট্রনিক গ্যাজেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়)-এর মতো মূল্যবান খনিজ সমৃদ্ধ এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। কঙ্গো সরকার জানিয়েছে, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সংঘাতে অন্তত ৭ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যেভাবে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে, কঙ্গোও তেমনটাই চাইছে। এক্ষেত্রে কঙ্গোর খনিজ সম্পদের বিনিময়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা পাওয়া যেতে পারে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সম্ভবত সরাসরি সৈন্য পাঠানোর পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে কঙ্গোকে সহায়তা করতে পারে।
কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের মতে, ইউক্রেনকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবনা থেকে তারা এই ধারণা পেয়েছেন। যেখানে ইউক্রেন তার খনিজ রাজস্বের ৫০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়েছে, যার বিনিময়ে দেশটি স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সহায়তা পাবে।
খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ ডিআরসি-তে টিন, টাংস্টেন, ট্যানটালাম এবং সোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে, যা একসঙ্গে ‘3TG’ নামে পরিচিত। এগুলো ইলেকট্রনিকস, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং অন্যান্য প্রযুক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
ধারণা করা হয়, ডিআরসির এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আফ্রিকা বিষয়ক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা আফ্রিকা বিজনেস কাউন্সিল সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখে ডিআরসির অনাবিষ্কৃত খনিজ সম্পদ খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে। তারা কঙ্গোর সিনেটের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও সীমান্ত সুরক্ষা কমিটির প্রধানের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব দিয়েছে।
তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্বের বিনিময়ে এই বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, কঙ্গো উন্নত প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করে। তাই এই খাতে অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত।
তবে, এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হবে।
ডিআরসিতে গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে সংঘাত চলছে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশটির দুর্বল সামরিক বাহিনীর কারণ হলো সরকারের দুর্নীতি।
১৯৯৬ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে এখানে দুটি গৃহযুদ্ধ হয়েছে। বর্তমানে এম২৩-এর বিদ্রোহ দেশটির জন্য নতুন সংকট তৈরি করেছে।
এম২৩ দেশটির গুরুত্বপূর্ণ দুটি শহর গোমা ও বুকাভু দখল করে নিয়েছে এবং তৃতীয় শহর ওয়ালিকালের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ খনি কেন্দ্র।
সংঘাতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রতিবেশী রুয়ান্ডার বিতর্কিত ভূমিকা। জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই রুয়ান্ডাকে এম২৩-কে সমর্থন ও অস্ত্র সরবরাহের জন্য অভিযুক্ত করেছে। রুয়ান্ডা অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ডিআরসির খনিগুলোর ওপর এম২৩-এর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রুয়ান্ডা আবারও দেশটির খনিজ সম্পদ লুট করতে চাইছে। এর আগে কঙ্গোর গৃহযুদ্ধের সময় রুয়ান্ডা ও তার মিত্র দেশ উগান্ডা দেশটির খনিজ সম্পদ লুটের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অতীতে, কঙ্গোর সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা চীনের সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য খনিজ সম্পদ বিষয়ক কিছু চুক্তি করেছিলেন, যা স্বচ্ছতার অভাবে সমালোচিত হয়েছিল।
বর্তমানে ডিআরসির খনিজ শিল্পে চীনা কোম্পানিগুলোর আধিপত্য রয়েছে। দেশটির কোবাল্ট খনিগুলোর অর্ধেকের বেশি চীনাদের নিয়ন্ত্রণে। তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স তশিসেকাদির সরকার চীন থেকে সরে এসে অন্যান্য দেশের বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ডিআরসির খনিজ সম্পদ রপ্তানির জন্য প্রতিবেশী দেশ অ্যাঙ্গোলার সঙ্গে রেল ও বন্দর নির্মাণের একটি অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে এই সম্পর্ক আরও বেশি ব্যবসায়িক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জাম কঙ্গোর চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক কোনো পরিবর্তন আনবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়।
সম্ভবত এই সহায়তা কঙ্গোর দুর্বল সামরিক বাহিনীকে দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা