যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সামরিক জোট গঠনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এই উদ্যোগটি মূলত যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমারের প্রস্তাবের ফল, যেখানে একটি ‘ইচ্ছুক জোটের’ মাধ্যমে শান্তি পরিকল্পনা তৈরির কথা বলা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পেশ করা হবে। তবে, ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে ইতোমধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী এক উচ্চপদস্থ সামরিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে আল জাজিরাকে জানান, অংশগ্রহণকারী দেশগুলো শান্তিরক্ষী মিশনের প্রয়োজনীয়তা এবং এতে বিভিন্ন দেশের সম্ভাব্য অবদান নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করছে। সূত্রটি আরও জানায়, এই মিশনে যুক্তরাষ্ট্র যদি সহায়তা করতে চায়, তাহলে তাদের সক্ষমতা কেমন হবে, সে বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হতে পারে।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হলে কয়েক হাজার সৈন্যের প্রয়োজন হবে। বর্তমানে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ এবং রাশিয়ার সৈন্য সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার। এছাড়া, রাশিয়া বহুজাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর ধারণার ঘোর বিরোধী।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত শান্তিরক্ষী মিশনে সরাসরি অংশগ্রহণের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মূলত ইউরোপের।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া, মানবিক করিডোর তৈরি এবং সামরিক সমন্বয়ের মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে শান্তিরক্ষী মিশনের ধারণা সফল হতে পারে। তবে, রাশিয়া যদি এক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে রাজি না হয়, তাহলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠবে।
বর্তমানে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠনে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে, নরওয়ে ও তুরস্কের মতো ইইউ বহির্ভূত দেশ এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোও এতে সমর্থন দিতে পারে।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সূত্রটি জানায়, ইউরোপে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হলে, তার প্রভাব বিশ্বজুড়ে পড়বে এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রধান কাজ হবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা। কারণ, কোনো ইউরোপীয় দেশ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে রাজি হবে না। কারণ, এতে ন্যাটো সনদের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হতে পারে, যা রাশিয়ার জন্য একটি সতর্কবার্তা।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইউরোপীয় বাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল বেন হজেস বলেন, শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের মতো নীল হেলমেট পরিধান করতে পারে, তবে রাশিয়ার কাছ থেকে তারা সহযোগিতা নাও পেতে পারে। তাই, এই বাহিনীর পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, শান্তিরক্ষী বাহিনীকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।
সামরিক সূত্রটি জানায়, শান্তিরক্ষী বাহিনীর এখতিয়ার নিয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।
অন্যদিকে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এই উদ্যোগকে ‘উদ্ধতপূর্ণ পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং এটিকে কিয়েভ সরকারকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্ররোচিত করার শামিল বলে মনে করেন।
শান্তিরক্ষী বাহিনীর অবস্থান নিয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। হজেস বলেন, যদি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বাহিনী মোতায়েন করা হয়, তাহলে সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। কারণ, বর্তমানে এই দুই দেশের মধ্যে ১০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সীমান্ত রয়েছে এবং সৈন্যদের নিয়মিত বিরতিতে সেখানে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা হয়তো এই মিশনে কেবল সহায়তা দিতে পারে। তবে, শেষ পর্যন্ত ইউরোপকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এই বহুজাতিক বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অতীতে দেশ দুটি বিভিন্ন সফল সামরিক জোট গঠন করেছে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কিছু মিশনে ব্যর্থতা দেখা গেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার এবং ফ্রান্সের ২ লাখ ২ হাজার।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়েছে। তবে, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইউরোপের দেশগুলো এখনো ঝুঁকি নিতে দ্বিধা বোধ করে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা