ফ্লোরিডার টাম্পা শহরে অভিবাসনের ঢেউ কিভাবে এক দারুণ রন্ধন-ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে, সেই গল্প শুনুন। এই শহরের খাদ্যের জগৎ এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে, যার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন দেশের মানুষের সংস্কৃতি আর রন্ধনশৈলীর মিশ্রণ।
টাম্পা শহরের কেন্দ্র থেকে একটু দূরে, ইবোর সিটি নামের একটি জায়গায় গেলেই চোখে পড়ে পুরনো দিনের স্থাপত্যশৈলী, যেখানে এক সময় কিউবান অভিবাসীরা এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ১৮৮০ ও ৯০-এর দশকে এই অঞ্চলের প্রধান আকর্ষণ ছিল সিগার তৈরি।
কিউবা থেকে আসা শ্রমিকদের হাত ধরে এখানে গড়ে ওঠে এক বিশেষ সংস্কৃতি। শুধু কিউবা নয়, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষেরা ধীরে ধীরে এই শহরের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন।
ইবোর সিটির পুরনো দিনের ফ্যাক্টরিগুলো এখন রেস্টুরেন্ট আর দোকানে পরিণত হয়েছে, তবে এখানকার মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এখনো সেই অভিবাসী সংস্কৃতির ছোঁয়া লেগে আছে। বর্তমানে টাম্পা আমেরিকার অন্যতম সেরা খাদ্য শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, যেখানে রয়েছে পাঁচটি মিশেলিন-তারকা রেস্টুরেন্ট এবং আরও অনেক রেস্টুরেন্ট, যারা ‘Bib Gourmand’ অথবা ‘Michelin Recommends’ খেতাব পেয়েছে।
টাম্পার খাবারের গল্প আসলে এই শহরেরই গল্প। এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট ‘দ্য কলম্বিয়া’ ১৯০৫ সালে খোলা হয়েছিল, যেখানে মূলত ইবোর সিটির সিগার ফ্যাক্টরিতে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য খাবার পরিবেশন করা হতো।
এই রেস্টুরেন্টে স্প্যানিশ ও কিউবান খাবারের এক দারুণ মিশ্রণ পাওয়া যায়। কলম্বিয়ার মেনুর প্রধান আকর্ষণ হলো কিউবান স্যান্ডউইচ।
এই স্যান্ডউইচে থাকে স্প্যানিশ হ্যাম, ইতালীয় সালামি, কিউবান স্টাইলের রোস্ট করা মাংস, সুইস চিজ, আচার এবং মাস্টার্ড, যা জার্মান ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষের অবদান। এই স্যান্ডউইচ পরিবেশন করা হয় ‘লা সেগুন্ডা’ নামের একটি পুরনো কিউবান বেকারি থেকে আনা রুটি দিয়ে।
‘লা সেগুন্ডা’ বেকারির গল্পটাও বেশ আকর্ষণীয়। ১৯১৫ সালে স্পেন থেকে আসা জুয়ান মোরে নামের এক ব্যক্তি এই বেকারিটি প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি কিউবায় থাকাকালীন রুটি তৈরির কৌশল শিখেছিলেন। বর্তমানে এই বেকারি শুধু ‘দ্য কলম্বিয়া’ রেস্টুরেন্টেই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের আরও অনেক রেস্টুরেন্টে রুটি সরবরাহ করে।
বেকারির ভেতরে পুরনো দিনের ছবিগুলো দেখলে অভিবাসন ও সংস্কৃতির এক দারুণ চিত্র ফুটে ওঠে। এখানে পাওয়া যায় জার্মান চকোলেট কেক, ইতালীয় ক্যানোলি এবং কিউবান স্টাইলের বিভিন্ন পেস্ট্রি।
ইবোর সিটি থেকে গাড়িতে দশ মিনিটের পথ পেরোলেই ডাউনটাউন, যেখানে আধুনিক স্থাপত্যের ভিড়েও অভিবাসনের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। টাম্পা বে হিস্টোরি সেন্টারের কাছেই স্পার্কম্যান ওয়ার্ফ নামের একটি ফুড কোর্ট রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতির খাবারের স্বাদ উপভোগ করা যায়।
এখানে বিভিন্ন দেশের শেফদের তৈরি করা খাবার পাওয়া যায়, যেমন গ্যালিটো টাকুইরিয়াতে পরিবেশিত হয় আকর্ষণীয় টাকো এবং ডাং ডুডে কোরিয়ান স্টাইলের পর্ক বান।
সন্ধ্যায় এখানকার একটি রেস্টুরেন্টে বসে আমি স্থানীয়ভাবে তৈরি করা ফ্রাইড শ্রিম্পের স্বাদ নিলাম। এই শহরে সি-ফুডের বিশাল সম্ভার রয়েছে, কারণ এটি মেক্সিকো উপসাগরের কাছে অবস্থিত।
এরপর আমি গেলাম ইতালীয় খাবারের স্বাদ নিতে, যেখানে মিশেলিন-তারকা প্রাপ্ত ‘রক্কা’ রেস্টুরেন্ট অবস্থিত। এখানে তারা সাধারণ উপাদানে অসাধারণ সব খাবার পরিবেশন করে।
যেমন টরটেলো আলো’উওভো, যা অনেকটা রাভিয়োলির মতো, স্পিনাক ও রিকোট্টা দিয়ে তৈরি করা হয়। এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত খাবার হলো ‘মোজারেলা কার্ট’।
টাম্পার খাদ্য সংস্কৃতিতে গ্রিক সংস্কৃতির প্রভাবও রয়েছে। ‘পসোমি’ নামের একটি গ্রিক রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় ‘মেড মর্নিং ইয়োগার্ট বাওল’, যা সেখানকার স্থানীয়দের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
টাম্পার খাদ্য সংস্কৃতির মতোই এখানকার ককটেল সংস্কৃতিও বেশ জনপ্রিয়। হোটেল হায়াতে অবস্থিত ফ্লোর ফিনা বারে তরুণ বারটেন্ডার নাটালি ওয়াকার তৈরি করেন ‘ডোস অ্যাগেভস’ নামের একটি ককটেল, যা টেকিলা, মেজকাল, লেবুর রস, নাশপাতি ও হিসবিস্কাস লিকিউর দিয়ে তৈরি করা হয়।
টাম্পার এই খাদ্য সংস্কৃতি যেন অভিবাসনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে এখানকার খাদ্য জগৎ এক নতুন রূপ লাভ করেছে, যা ভ্রমণকারীদের জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক