রাশিয়ার কারাগারে মুসলিম বন্দিদের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ায় কারাবন্দী মুসলিমদের মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘিত হচ্ছে।
বিশেষ করে, তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে সাইবেরিয়ার একটি কারাগারে বন্দী হওয়া ক্রিমীয় তাতার সম্প্রদায়ের নেতা নারীমান জহেলিয়ার কথাই ধরা যাক। তিনি জানান, কারাগারে তাকে যে খাবার দেওয়া হতো, তার বেশিরভাগেই শুকরের মাংস ছিল, যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
তিনি বলেন, “আমি শুধু রুটি খেতাম, যা খুব ভালো মানের ছিল না এবং চা দিয়ে কোনোমতে চলতো।” জহেলিয়ার বিরুদ্ধে যদিও গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস এবং বিস্ফোরক পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে, যা তিনি অস্বীকার করেছেন।
কারাগারে মুসলিম বন্দিদের জন্য খাদ্যাভ্যাস একটি বড় সমস্যা। খাবার ছাড়াও, রাশিয়ার কারাগারগুলোতে মুসলিমদের জন্য আরও অনেক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে।
সোভিয়েত আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত, রাশিয়ার কারাগারগুলো এক অন্ধকার জগৎ হিসেবে পরিচিত, যেখানে কঠোর নিয়ম-কানুন এবং এক ধরনের অঘোষিত শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান।
কুখ্যাত “কোরোনা পরানো চোর” বা “কালো কাস্ট”-এর সদস্যরা এখনো তাদের পুরনো কায়দায় চলে। তাদের শরীরে জটিল ট্যাটু থাকে এবং তারা নিজস্ব ভাষায় কথা বলে।
কারাগারের ভেতরের এই গোষ্ঠী মাদক পাচার, জুয়া খেলা এবং চরম সহিংসতার সঙ্গে জড়িত।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, গত দুই দশকে রাশিয়ান কারাগারে মুসলিম বন্দীর সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। তাদের বিরুদ্ধে “সন্ত্রাসবাদ” এবং “জঙ্গিবাদ”-এর মতো অভিযোগ আনা হচ্ছে।
রাশিয়ার প্রায় ১৪ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৫ শতাংশ মুসলিম। কারাগারের মোট জনসংখ্যার মধ্যেও মুসলিম বন্দীর সংখ্যা প্রায় একই – প্রায় ৩১ হাজার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ায় কোনো ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে, তাকে “জঙ্গিবাদে জড়িত” হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তার ওপর বিশেষ নজর রাখে। এমনকি, অনেক সময় তাদের কারাদণ্ডের মেয়াদও বাড়ানো হয়।
প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা আনা কারেতনিকোভা জানিয়েছেন, কোনো কয়েদি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে তাকে সম্মানিত করা হয়, কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে চরমপন্থী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
মধ্য এশিয়া থেকে আসা মুসলিম অভিবাসীরাও রাশিয়ায় নির্যাতনের শিকার হন। ভাষার দুর্বলতা এবং স্থানীয় আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে তাদের সহজেই অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়।
অনেককে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি, মস্কোর এক নির্মাণ শ্রমিক আব্দুল আজিজ জানান, তার ছোট ভাই আব্দুলমুমিনের কাছে পুলিশ “স্পাইস” নামে একটি মাদক দ্রব্য রেখে তাকে ফাঁসিয়েছে।
পুলিশ তাকে মারধর করে এবং প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে আঘাত করে স্বীকারোক্তি আদায় করে। পরে আদালত আব্দুলমুমিনকে পাঁচ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেয়।
তবে কিছু কারাগারে মুসলিম বন্দিদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতির চিত্রও দেখা যায়। নারীমান জহেলিয়ার কারাকারে তাদের নামাজ পড়ার এবং রমজানে খাবার খাওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো।
তারা কোরআন এবং অন্যান্য ইসলামিক বইও পড়তে পারতেন।
কারাগারে মুসলিম বন্দিদের অধিকার রক্ষার জন্য কিছু প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আজাত গাওনুতদিনভ নামে এক ব্যক্তি, যিনি কারাগারে ইসলাম গ্রহণ করেছেন, বন্দীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
তিনি জানান, কারাগারের কর্মীদের ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাশিয়ার সরকার এবং কারাগার প্রশাসন মুসলিম বন্দিদের সমস্যা সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তাদের প্রতি কেবল কঠোর মনোভাব দেখানো হয়, কিন্তু তাদের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করা হয় না।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা