ট্রাম্পের কূটনীতি কি বিশ্বনেতাদের জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে নেওয়া কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলো তাদের নিজ দেশে রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিচ্ছে কিনা, তা এখন আলোচনার বিষয়। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করে খুব বেশি ছাড় না দিয়ে যারা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন, তাদের জন সমর্থন বাড়ছে।
উদাহরণস্বরূপ, মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেইনবাম ১৯৮৫ সালের পর দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তার রেকর্ড গড়েছেন। কানাডার ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির সঙ্গে ভোটের ব্যবধান কমিয়ে এনেছে, যেখানে একসময় কনজারভেটিভ পার্টি এগিয়ে ছিল। শুধু এই দুটি দেশই নয়, আরও অনেক দেশের নেতাদের ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে কি এই জনসমর্থন বাড়ছে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? আসুন, কয়েকটি দেশের উদাহরণ দেখা যাক।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত ৯ মার্চ পদত্যাগ করেন এবং তার দল লিবারেল পার্টির মার্ক কার্নি নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ট্রুডোর পদত্যাগের আগে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান খরচ, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ এবং অভিবাসন নীতি নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর কানাডার ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিলে এই চাপ আরও বাড়ে। ট্রাম্প কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য বানানোর ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছিলেন এবং ট্রুডোকে ব্যঙ্গ করে ‘গভর্নর’ বলেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ট্রুডো তখন মাদক চোরাচালান বন্ধে ব্যবস্থা নিতে একজন ‘ফেন্টানিল czar’ নিয়োগ করেন।
পরে অবশ্য ট্রাম্প কানাডার অনেক পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন। এর জবাবে ট্রুডো স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘কানাডিয়ানরা যুক্তিবাদী এবং ভদ্র, তবে দেশের স্বার্থের প্রশ্নে আমরা পিছপা হব না’।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পয়েলিয়েভরের দল ২০২২ সাল জুড়েই এগিয়ে ছিল। তবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে লিবারেল পার্টির জনসমর্থন বাড়তে শুরু করে এবং তারা ব্যবধান কমাতে সক্ষম হয়।
কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (CBC) জরিপ অনুযায়ী, জানুয়ারির শুরুতে কনজারভেটিভ পার্টি লিবারেল পার্টির চেয়ে ২৪ শতাংশ পয়েন্ট এগিয়ে ছিল। বর্তমানে সেই ব্যবধান কমে ৫.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যেখানে কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থন ৩৮.৯ শতাংশ এবং লিবারেল পার্টির সমর্থন ৩৩.৪ শতাংশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ‘৩৮৮কানাডা’ ওয়েবসাইটের নির্মাতা ফিলিপ জে ফোরনিয়ার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কানাডার নির্বাচনের ইতিহাসে, অন্তত এই শতকে, এমনটা আগে দেখা যায়নি। প্রায় ২৫ শতাংশ ভোটের ব্যবধান কমানো, বিশেষ করে এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকারের জন্য খুবই অস্বাভাবিক’।
বিশ্লেষকদের মতে, লিবারেল পার্টির এই সাফল্যের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগ, মার্ক কার্নির আগমন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকি এবং কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পয়েলিয়েভরের প্রতি জনগণের অসন্তুষ্টি।
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেইনবাম ছিলেন দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকির জবাবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে ১০ হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য মোতায়েন করেন।
ট্রাম্প প্রথমে মেক্সিকো এবং কানাডার সব পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তবে শেইনবাম ও ট্রুডোর সঙ্গে আলোচনার পর তা এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়।
মেক্সিকোর বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, শেইনবাম ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই উচ্চ জনপ্রিয়তা উপভোগ করছেন। বুয়েনডিয়া ওয়াই মার্কেজ-এর জরিপে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ৮০ শতাংশ মানুষ প্রেসিডেন্টের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
এল ফাইনান্সিয়েরো পত্রিকার জরিপে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে ৮৫ শতাংশ মানুষ শেইনবামকে সমর্থন করেছেন, যা গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
শেইনবাম ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক ভালোভাবেই সামলাচ্ছেন বলে মনে করেন মেক্সিকোর অনেক নাগরিক। এল ফাইনান্সিয়রোর ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে অভিবাসন সমস্যা ভালোভাবেই মোকাবেলা করছেন।
শুল্কের ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশ মানুষ শেইনবামের কাজে সমর্থন দিয়েছেন।
অন্যদিকে, যখন শেইনবাম সরকারের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক কেমন, জানতে চাওয়া হয়েছিল, তখন ৩৮ শতাংশ মানুষ এই সম্পর্ককে ভালো বা খুবই ভালো বলেছেন, যেখানে ৪৫ শতাংশ মানুষ এই সম্পর্ককে খারাপ বা খুবই খারাপ বলেছেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও ট্রাম্পের সম্পর্ক ভালো নয়। ট্রাম্প সম্প্রতি জেলেনস্কিকে ‘নির্বাচনবিহীন একনায়ক’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তাঁর জনপ্রিয়তা ৪ শতাংশ বলে দাবি করেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প ও তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভেন্স প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের জন্য জেলেনস্কি যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেননি। এরপর ট্রাম্প ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেন।
তবে জেলেনস্কি ট্রাম্পের প্রতি নমনীয় মনোভাব বজায় রাখেন এবং শান্তি আলোচনার জন্য প্রস্তুত বলে জানান। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সোসিওলজি (KIIS)-এর এক জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের সঙ্গে মতবিরোধের পর মার্চ মাসে ৬৭ শতাংশ মানুষ জেলেনস্কিকে সমর্থন করেছেন, যা ফেব্রুয়ারির তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। স্টারমারের জনপ্রিয়তা তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ম্যাক্রোঁর জনপ্রিয়তাও ফেব্রুয়ারির ১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে মার্চে ২৭ শতাংশ হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, স্টারমারের এই সাফল্যের কারণ হলো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষমতা।
ফ্রান্সে আন্তর্জাতিক সংকট, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ, জনগণের উদ্বেগের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। সম্ভবত ম্যাক্রোঁর ট্রাম্পকে সামলানোর দক্ষতাও তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করেছে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা