চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ‘ ভয়েস অফ আমেরিকা’ (ভিওএ) এবং ‘রেডিও ফ্রি এশিয়া’ (আরএফএ)-র কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরে আনন্দ প্রকাশ করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রশাসন কর্তৃক বাজেট কমানোর সিদ্ধান্তের পরেই এমনটা ঘটেছে।
চীনের সরকারি গণমাধ্যম এই ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং এই দুটি গণমাধ্যমকে আমেরিকার ‘প্রোপাগান্ডা’ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছে।
চীনের জাতীয়তাবাদী দৈনিক গ্লোবাল টাইমস এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “তথাকথিত স্বাধীনতার আলোকবর্তিকা ভিওএকে এখন তার নিজস্ব সরকারই একটি নোংরা ন্যাকড়ার মতো ছুড়ে ফেলেছে।” পত্রিকাটি ভিওএকে একটি ‘সাবধানে তৈরি করা প্রচারযন্ত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যার ‘প্রধান কাজ হলো আদর্শিক চাহিদার ভিত্তিতে অন্যান্য দেশগুলোর ওপর ওয়াশিংটনের আক্রমণকে সমর্থন করা’।
গ্লোবাল টাইমসের সাবেক সম্পাদক-ইন-চিফ হু সিজিনও এই মন্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি সামাজিক মাধ্যম ওয়েইবোতে দেওয়া এক পোস্টে এই গণমাধ্যম দুটির বিলুপ্তি ‘সত্যিই আনন্দদায়ক’ বলে উল্লেখ করেছেন।
হংকং-ভিত্তিক লেখক নুরি ভিটাসি, যিনি চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যমেও লিখেছেন, তিনিও এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই গোষ্ঠীগুলো বিশ্বজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের মনকে প্রভাবিত করতে ৬২টি ভাষায় ‘খবর’ প্রচার করে এবং তাদের মধ্যে আমেরিকান ঘেঁষা ধারণা তৈরি করে।
একইসঙ্গে চীন, রাশিয়া, ইরান এবং ওয়াশিংটন যাদের প্রতিপক্ষ বা ‘শত্রু’ মনে করে, তাদের বিরুদ্ধে মানুষের মনে বিদ্বেষ তৈরি করে।”
যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং মঙ্গলবার ভিওএকে ‘সংঘাত উস্কে দেওয়া মিথ্যা তৈরির কারখানা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যাদের ‘চীন বিষয়ক খবরে কুখ্যাতি রয়েছে’।
ভিওএ এবং আরএফএ দীর্ঘদিন ধরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তাইওয়ান এবং উইঘুর মুসলিম সংখ্যালঘুদের মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোতে বেইজিংয়ের নীতির বিরুদ্ধে তারা খবর ও মতামত প্রচার করে এসেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সি ফর গ্লোবাল মিডিয়া (ইউএসএজিএম)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভিওএ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীনের জন্য প্রথম দিককার লক্ষ্য ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই গণমাধ্যমটি ৩ কোটি ৬১ মিলিয়ন শ্রোতা নিয়ে বিশ্বের ৪৯টি ভাষায় তাদের কার্যক্রম বিস্তার করে।
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ছোট আকারের আরএফএ’র চীনসহ পশ্চিমা বিশ্বের সাংবাদিকদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকাগুলোতে খবর প্রচারের জন্য এশিয়া জুড়ে তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক ছিল।
অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের চীন বিষয়ক গবেষণা ও বিশ্লেষণ প্রোগ্রামের প্রধান বেথানি অ্যালেন মনে করেন, “আরএফএ এবং ভিওএ এমন কিছু করে যা মূলত আর কেউ করে না, আর তা হলো চীনের ভেতরের শ্রোতাদের কাছে ইন্টারনেটবিহীন উপায়ে খবর পৌঁছে দেওয়া।
ভিওএ টিভি সম্প্রচার এবং আরএফএ রেডিওর মাধ্যমে সেসব মানুষের কাছে খবর পৌঁছায়, যাদের অন্য কোনো উপায়ে স্বাধীন তথ্য পাওয়ার সুযোগ নেই।
চীনের অনেক সেন্সরশিপ প্রতিরোধের সরঞ্জাম এখন অবৈধ এবং সেগুলো ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া, যারা ইন্টারনেট সম্পর্কে খুব একটা জানেন না, তাদের জন্য এগুলো ব্যবহার করা বেশ কঠিন।”
২০১৭ সালে আরএফএ তাদের উইঘুর ভাষার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রথম খবর প্রকাশ করে যে জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের ‘বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’-এ ব্যাপক হারে বন্দী করা হয়েছে। পরবর্তীতে, এই বিষয়ে বাযফিড নিউজ ও বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় এবং সেগুলোর জন্য তারা ২০২১ ও ২০২২ সালে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করে।
তাইওয়ান ভিত্তিক চায়না মিডিয়া প্রজেক্টের পরিচালক ডেভিড ব্যান্ডারস্কি আল জাজিরাকে বলেছেন, আরএফএ ‘চীনের এমন সব খবর পরিবেশন করে, যা অন্য কোনো গণমাধ্যমে আসে না’। তিনি আরও বলেন, “ভিওএ তার ইতিহাসে বিশাল প্রভাবশালী ছিল।
আমি গত ২০ বছরে অনেক চীনা সাংবাদিক ও সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করেছি, যারা ১৯৮০-এর দশকে শর্টওয়েভে ভিওএ শোনার কথা স্মরণ করেন। এটি একটি উদারনৈতিক শক্তি ছিল।”
ট্রাম্প শুক্রবার এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে ইউএসএজিএমকে ‘প্রযোজ্য আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত’ বিলুপ্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
শনিবার পর্যন্ত, ভিওএ-এর প্রায় ১,৩০০ জন কর্মী, যারা প্রায় সবাই, তাদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
ইউএসএজিএমের বাজেট ছিল ২০২৪ সালের জন্য ৮৮৬.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি প্রচারণার মোকাবিলায় প্রতিষ্ঠিত রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টি, মধ্যপ্রাচ্য সম্প্রচার নেটওয়ার্ক এবং ওপেন টেকনোলজি ফান্ডের কার্যক্রমও সম্ভবত বন্ধ হয়ে যাবে।
ট্রাম্প ও তাঁর মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরে ভিওএ এবং অন্যান্য সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত মার্কিন গণমাধ্যমের সমালোচনা করে আসছেন। তারা এগুলোর বিরুদ্ধে উদারনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষদের বিষয়ে অতিরিক্ত সহানুভূতি দেখানোর অভিযোগ করেছেন।
যদিও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংগঠন ও মূলধারার সাংবাদিকরা। তবে ভিওএ এবং এর সহযোগী নেটওয়ার্কগুলো তাদের সাংবাদিকতার মান নিয়েও সমালোচিত হয়েছে।
২০১৩ সালে ভিওএর সাবেক সাংবাদিক গ্যারি থমাস কলম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউতে লিখেছিলেন যে, এই গণমাধ্যমের ‘রাজনৈতিকভাবে ভুল গোপন বিষয়’ হলো এর ‘ভাষা বিভাগগুলোর মারাত্মকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সাংবাদিকতা’।
তিনি আরও লেখেন, “কারও কারও সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি, আবার কারও একেবারেই নেই। এর কারণ হলো, কোনো ভাষায় ভালো জ্ঞান আছে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন, যাদের ভিওএ-এর ঐতিহ্যগতভাবে প্রয়োজনীয় কঠোর সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাও রয়েছে।”
সোমবার, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা ভিওএর সাবেক সাংবাদিক ট্রেসি ওয়েন লি এক টুইটে জানান, এই নেটওয়ার্কের কিছু ‘দক্ষ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ চীনা ভাষার সাংবাদিক অভ্যন্তরীণভাবে নিউজ রুমে ‘পেশাদারিত্বের অভাব’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু পদোন্নতি থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে।
লি বলেন, “ভয়েস অফ আমেরিকা এবং রেডিও ফ্রি এশিয়ার চীনা বিভাগগুলোর নেতৃত্বে সাংবাদিকদের যে নিরপেক্ষতা থাকা দরকার, তা নেই এবং তারা যোগ্যতার ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করে না। তারা যাদের অতিথি হিসেবে ডাকে, তাদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব বাড়ছে।
এবং এখন, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে।”
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা।