পাকিস্তানের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ কৌশল: উদ্বেগের কারণ
সম্প্রতি, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী একটি যাত্রীবাহী ট্রেন হাইজ্যাক করে।
প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে জিম্মিদের মুক্ত করা গেলেও, সরকারি হিসাব অনুযায়ী, অন্তত আটজন সাধারণ নাগরিক নিহত হন। ঘটনার পরপরই পাকিস্তান সরকার এই ঘটনার জন্য প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তান ও ভারতকে দায়ী করে।
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, পাকিস্তান সরকার ক্রমশ তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দায় অন্যের উপর চাপানোর চেষ্টা করছে এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ মোড়কে উপস্থাপন করছে।
ট্রেন হাইজ্যাকের কয়েক মাস আগে, পাকিস্তানের যুদ্ধবিমানগুলো আফগানিস্তানের খোস্ত ও পাক্তিকা প্রদেশে বোমা হামলা চালায়।
এতে নারী ও শিশুসহ অন্তত ৪৬ জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে অনেকেই পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চল থেকে আসা বাস্তুচ্যুত মানুষ ছিলেন।
পাকিস্তান সরকার এই হামলাকে সমর্থন করে জানায়, তারা আফগান ভূখণ্ডে লুকিয়ে থাকা তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) জঙ্গিদের লক্ষ্য করে অভিযান চালিয়েছে।
বস্তুত, এই যুক্তিটি অনুসরণ করেই একসময় যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ নামে বিমান হামলা, অপহরণ ও টার্গেটেড কিলিংয়ের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে।
এর ফলে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে, যা যুদ্ধের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে, কিন্তু তাদের এই কৌশলের প্রভাব এখনো বিদ্যমান এবং এই অঞ্চলের সরকারগুলো প্রায়ই সেই পথ অনুসরণ করতে দেখা যায়।
পাকিস্তান সরকারও তাদের মধ্যে অন্যতম।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের দখলদারিত্বের সময়, পাকিস্তান আফগান তালেবানকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে গণ্য করতে অস্বীকার করে তাদের আশ্রয় ও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছিল।
অথচ, বর্তমানে তারা টিটিপি এবং বিএলএকে ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং আফগান তালেবান সরকারকে ‘সন্ত্রাসবাদের’ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অভিযুক্ত করছে।
স্থানীয় বিদ্রোহগুলোকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এবং তাদের অভিযোগগুলো শোনার পরিবর্তে, পাকিস্তান সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
পাকিস্তান কীভাবে এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করবে, তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
তবে সাম্প্রতিক মার্কিন অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসবাদের’ একটি ব্যাপক সংজ্ঞা তৈরি করেছিল, যার ফলে দেশের ভেতরের ও বাইরের অনেক মুসলিম সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।
আফগানিস্তানে, তারা আল-কায়েদা এবং তালেবানের সঙ্গে আফগান বেসামরিক নাগরিকদেরও অন্তর্ভুক্ত করে।
আফগান তালেবান সদস্যদের কারাবাস ও নির্যাতনের ফলে তাদের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন আরও বেড়ে যায়, যা সহিংসতার বিস্তার ঘটায়।
বেসামরিক জনবসতির উপর নির্বিচার ড্রোন হামলায় শুধু সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘনই হয়নি, বরং তরুণদের আফগান তালেবান ও টিটিপিতে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছে।
২০২১ সালে দুই দশক ধরে চলা যুদ্ধ এবং দখলের অবসানে যুক্তরাষ্ট্র যখন পরাজয় স্বীকার করে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়, তার আগে তালেবানের সঙ্গে তাদের কয়েকটি সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।
কোনো আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে আলোচনার পথ বন্ধ করে দেওয়া সহজ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এই ধরনের পদক্ষেপের ফল ভালো হয় না।
পাকিস্তানের উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ‘সন্ত্রাসবাদের’ পথে না হেঁটে টিটিপি এবং বিএলএর মতো গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করা।
তাদের নিজেদের নাগরিকদের অভিযোগগুলো শোনা এবং তাদের সঙ্গে সমঝোতার পথ খুঁজে বের করা জরুরি। বিএলএ ও টিটিপির কার্যক্রমের শিকার হওয়া বেসামরিক মানুষের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে হবে।
একই সঙ্গে, ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ অজুহাতে আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন এবং তালেবান সরকারকে দোষারোপ করা বন্ধ করতে হবে।
যদি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করে, তবে তাদের পরিণতিও একই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা