মহাবিশ্বের এক ভয়ংকর রূপ: নক্ষত্রের বিস্ফোরণ ও পৃথিবীর বুকে ধ্বংসলীলা
বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া বিশাল আকারের প্রজাতি বিলুপ্তি নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই বিলুপ্তিগুলি কিভাবে ঘটল, তা জানতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা নতুন এক তত্ত্বের সন্ধান পেয়েছেন।
সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, নক্ষত্রের ভয়ংকর বিস্ফোরণ বা সুপারনোভা (supernova) পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটা কয়েকটি বড় আকারের প্রজাতি বিলুপ্তির কারণ হতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, কোনো বিশাল নক্ষত্রের অন্তিম পর্যায়ে, তার মৃত্যুকালে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণকে সুপারনোভা বলা হয়।
এটি নক্ষত্রটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয় এবং এর থেকে নির্গত হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি ও বিকিরণ। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, গত ১ বিলিয়ন বছরে আমাদের সৌরজগতের কাছাকাছি, প্রায় ৬৫ আলোকবর্ষের মধ্যে, সম্ভবত ২.৫টি সুপারনোভা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই গবেষণাটি ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘গাইয়া’র (Gaia) ডেটা ব্যবহার করে করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সুপারনোভাগুলি পৃথিবীর জীবজগতের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, প্রায় ৪৪৫ মিলিয়ন বছর আগে অর্ডোভিসিয়ান যুগে (Late Ordovician) এবং ৩৭২ মিলিয়ন বছর আগে ডেভোনিয়ান যুগে (Late Devonian) ঘটে যাওয়া ব্যাপক প্রজাতি বিলুপ্তির পেছনে সুপারনোভা অন্যতম কারণ হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অফ কীল-এর পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার অধ্যাপক এবং আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ফেলো, নিক রাইট (Nick Wright) বলেন, “সুপারনোভাগুলি বিলুপ্তি ঘটাতে পারে, এমন ধারণাটি এখন আরও বেশি গ্রহণযোগ্য।”
এই গবেষণার প্রধান লেখক, অ্যালেক্সিস কুইন্টানা (Alexis Quintana) বলেন, “সুপনোভা বিস্ফোরণগুলি ভারী রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে, যা নতুন নক্ষত্র এবং গ্রহ তৈরি করতে সাহায্য করে।
তবে কোনো গ্রহ, যেমন পৃথিবী, যদি এই ধরনের বিস্ফোরণের খুব কাছে থাকে, তাহলে তার ধ্বংস অনিবার্য।”
তবে, বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত সুপারনোভা থেকে বিলুপ্তি ঘটেছে, এমন সরাসরি প্রমাণ পাননি। তাদের মতে, সুপারনোভা পৃথিবীর ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এর ফলে ব্যাপক ধ্বংসলীলা সৃষ্টি হতে পারে।
এই প্রসঙ্গে, ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইক বেনটন (Mike Benton) বলেন, “এই তত্ত্বটি এখনো পরীক্ষিত নয়।
তবে, সুপারনোভা এবং বিলুপ্তির ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক প্রমাণ করতে হলে, আমাদের আরও নির্দিষ্ট প্রমাণ দরকার।”
বস্তুত, অতীতে পৃথিবীর বুকে একাধিকবার এই ধরনের ব্যাপক প্রজাতি বিলুপ্তি ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ঘটনাটি হলো, প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপের কাছে একটি বিশাল আকারের গ্রহাণুর (asteroid) ধাক্কা।
এর ফলে ডাইনোসরসহ পৃথিবীর বহু প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
এই ঘটনার প্রমাণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা ‘ইরিডিয়াম’ নামক একটি বিরল মৌলের সন্ধান পান, যা সাধারণত পৃথিবীর পৃষ্ঠে পাওয়া যায় না, তবে উল্কাপিণ্ডের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে থাকে।
লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল উইগনাল (Paul Wignall) এই গবেষণাটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।
তার মতে, সুপারনোভা থেকে বিলুপ্তির ধারণা নতুন নয়, তবে এর স্বপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ প্রয়োজন।
বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন, সুপারনোভা এবং অন্যান্য মহাজাগতিক ঘটনাগুলি পৃথিবীর জীবজগতের উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও গবেষণা হলে, আমরা সম্ভবত এই রহস্যের আরও গভীরে যেতে পারব।
তথ্যসূত্র: সিএনএন