যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ এখন ওয়ালমার্টের মতো বৃহৎ কোম্পানিগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন সরকার চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করায়, এর প্রভাব পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে।
ওয়ালমার্ট এই বাড়তি শুল্কের বোঝা চীনা সরবরাহকারীদের উপর চাপাতে চেয়েছিল, কিন্তু চীন সরকার এতে রাজি হয়নি। ফলে, মার্কিন ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে চীন থেকে আসা পণ্যের উপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। ওয়ালমার্ট যেহেতু চীন থেকে প্রচুর পণ্য আমদানি করে, তাই তারা এই শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল।
তারা তাদের চীনা সরবরাহকারীদেরকে পণ্যের দাম কমানোর জন্য চাপ দেয়, কিন্তু চীন সরকার এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
চীনের এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ ক্রমশ বাড়ছে এবং এর মধ্যে আমেরিকান কোম্পানিগুলো উভয় সংকটে পড়েছে। একদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা চায় কম দামে পণ্য কিনতে, অন্যদিকে চীন সরকারের আপত্তির কারণে ওয়ালমার্টের পক্ষে দাম কমানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়ালমার্টের মতো একটি শক্তিশালী কোম্পানির যদি দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা হয়, তাহলে ছোট কোম্পানিগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হবে।
জানা গেছে, ওয়ালমার্ট কিছু চীনা সরবরাহকারীকে, যেমন – যারা রান্নার সরঞ্জাম ও পোশাক সরবরাহ করে, তাদের পণ্যের দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে বলেছিল। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হে ইয়ংচিয়ান জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তারা ওয়ালমার্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং কোম্পানিটি তাদের ব্যাখ্যা দিয়েছে।
ওয়ালমার্ট জানিয়েছে, তারা সবসময় চেষ্টা করে গ্রাহকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে। সরবরাহকারীদের সঙ্গে তাদের আলোচনা মূলত এই লক্ষ্যের দিকেই ছিল।
তবে, বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়ালমার্ট এখন হয় পণ্যের দাম বাড়াতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের অসন্তুষ্ট করবে, অথবা সরবরাহকারীদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা চীন সরকারের ক্রোধের কারণ হবে।
চীনের এই প্রতিক্রিয়া মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্টের পূর্বাভাষের বিপরীত। বেসেন্ট বলেছিলেন, চীনা প্রস্তুতকারকরাই এই শুল্কের বোঝা বহন করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে না।
কিন্তু বাস্তবে, চীন সরকার জানিয়েছে, তারা এই শুল্কের দায় নিতে রাজি নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তাদের জন্য এই শুল্ক বৃদ্ধি একটি কঠিন সময়ে এসেছে। সম্প্রতি, মানুষ বিমান ভ্রমণ, বাড়ির সংস্কার, পোশাক ও হালকা খাবারের মতো খাতে খরচ কমাচ্ছে।
গত মাসে খুচরা বিক্রিও অপ্রত্যাশিতভাবে কমেছে, যা ভোক্তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
ওয়ালমার্ট দীর্ঘদিন ধরে তার বিশাল বাজারের ক্ষমতা ব্যবহার করে পণ্যের দাম কম রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চীনা সরকারের প্রতিরোধের কারণে, সরবরাহকারীদের উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ওয়ালমার্ট তার প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রায় ২০ শতাংশ চীন থেকে সংগ্রহ করে।
বিশেষজ্ঞ জোসেফ জুরকেন মনে করেন, চীনের এই পদক্ষেপ শুধু সরবরাহকারীদের প্রতি নয়, বরং এটি একটি জাতীয় বার্তা। চীন সম্ভবত বলছে, তারা আর এই শুল্কের বোঝা বহন করতে রাজি নয়।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারই নয়, চীনের বাজারেও ওয়ালমার্টের ব্যবসা রয়েছে। গত বছর চীনে ওয়ালমার্টের বিক্রি ১৬ শতাংশ বেড়ে ১৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন সরকারের চাপ অব্যাহত থাকলে, চীনের বাজারেও ওয়ালমার্টের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তবে, বিশ্লেষক মাইকেল বেকার মনে করেন, অন্য অনেক কোম্পানির চেয়ে ওয়ালমার্ট এই পরিস্থিতি ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারবে। কারণ, ওয়ালমার্টের দুই-তৃতীয়াংশ পণ্য তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রেই।
এছাড়াও, ওয়ালমার্টের সরবরাহকারীদের একটি বড় অংশ রয়েছে, যারা ৭০টিরও বেশি দেশ থেকে পণ্য সরবরাহ করে। তাই, তারা শুধু চীনের উপর নির্ভরশীল নয়।
চীন সরকারের এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আচরণের অংশ। চীন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি পণ্য আমদানির উপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছে।
এছাড়াও, চীনের বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অ্যান্টি-মনোপলি আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গুগল-এর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। পোশাক কোম্পানি পিভিএইচ (Calvin Klein ও Tommy Hilfiger এর মূল কোম্পানি) এবং বায়োটেক কোম্পানি ইলুমিনাকেও তারা ‘অবিশ্বস্ত সত্তা’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন