সুদূর সুইডেন থেকে আসা একজন শিল্পী, যিনি প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে গিয়ে শিল্পের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন— গুস্তাফ ব্রোমস। ছবি আঁকা থেকে শুরু করে পারফর্মেন্স আর্ট, শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে বিচরণ তাঁর। প্রচলিত সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে প্রকৃতির কাছাকাছি, মানুষের মাঝে মিশে গিয়ে তিনি তৈরি করেন তার শিল্পকর্ম।
নব্বইয়ের দশকে ব্রোমস ভারতের উত্তরাঞ্চলে, নেপাল ও তিব্বতের সীমান্ত ঘেঁষা কুমায়ুনে পাড়ি জমান। সেখানকার নির্জন পরিবেশে, প্রকৃতির মাঝে তিনি খুঁজে পান শিল্পের নতুন উপাদান। তাঁর ভাষায়, এই স্থানটি ছিল তাঁর জন্য এক নতুন দুয়ার। এর আগে, ব্রুকলিনের উইলিয়ামসবার্গে নিজের পুরোনো সব কাজ—ছবি, আঁকা— পুড়িয়ে ফেলেন।
তাঁর মনে হয়েছিল, এই কাজটিই যেন তাঁর প্রথম শিল্পকর্ম। ছাইগুলো একত্র করে তিনি এর নাম দেন ‘প্রথম কাজ’। এরপর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি খুঁজে পান হাড়।
তাঁর মনে হয়, এর মধ্যে এক বিশেষ শক্তি রয়েছে। এরপর থেকে তিনি কোনো বস্তুর প্রতিরূপের বদলে, সেই বস্তুটির সঙ্গেই শিল্প সৃষ্টি করতে শুরু করেন। শুকনো ফুল, হাড়—এসব উপকরণ ব্যবহার করে বিশাল কার্পেট ফ্যাক্টরিতে তিনি তৈরি করেন অপূর্ব সব শিল্পকর্ম, যা স্থানীয় কিছু মানুষ ও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ভারতে থাকার পর তিনি যখন সুইডেনে ফিরে আসেন, তখন স্টকহোমের একটি ভূগর্ভস্থ গুহায় তাঁর কাজগুলো প্রদর্শন করেন। সেখানে তিনি অনুভব করেন, দর্শকদের কোনো সুন্দর দৃশ্যের ছবি দেখানোর বদলে, তিনি তাদের জন্য সেই দৃশ্যটিই তৈরি করতে পারেন, যা তারা সরাসরি অনুভব করতে পারবে। এরপর তিনি পারফর্মেন্স আর্টের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
২০০৫ ও ২০০৬ সালে, তিনি তাঁর সঙ্গী ত্রিশা লিটলারের সঙ্গে ‘এ ওয়াকিং পিস’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন। তাঁরা পায়ে হেঁটে ভেন্ডেল থেকে ইউক্রেনের ওডেসা পর্যন্ত ভ্রমণ করেন এবং সেই যাত্রাপথে তোলা ছবিগুলো দিয়ে তৈরি করেন আকর্ষণীয় ট্রিপটিক।
পোল্যান্ডের কাটোভিৎস ও গ্লিভাইসের শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেখানকার পরিবেশ ছিল কিছুটা ভীতিজনক। তবে সাধারণত তাঁরা বনের মধ্যে হেঁটেছেন এবং পথ চলতে দেখা হওয়া মানুষের কাছ থেকে পেয়েছেন অকৃপণ সহযোগিতা।
এর এক বছর পর, ব্রোমস স্টকহোমের কেন্দ্রস্থলে, ব্যস্ত সময়ে এক বছর ধরে ‘দ্য সিটিং’ নামে একটি পারফর্মেন্স করেন। তাঁর এই কাজটি সবার কাছে ভালো লাগেনি। নিরাপত্তা কর্মীরা তাঁকে হেনস্থা করেছে, এমনকি কেউ কেউ তাঁর দিকে থুথুও ছুঁড়েছে। কিন্তু ব্রোমস এসবকে তেমন একটা পাত্তা দেননি।
২০১৬ সালের একটি তথ্যচিত্রে দেখা যায়, তিনি মাটিতে শুয়ে আছেন, তাঁর মুখে মাটি, শরীরে কিলবিল করছে কেঁচো। তাঁর কাজগুলোকে অনেকে রাজনৈতিক প্রতিবাদ, বিজ্ঞাপন অথবা নিছক পাগলামি হিসেবেও দেখেছেন। ব্রোমস এসবকে স্বাগত জানিয়েছেন।
গ্যালারি বা উৎসবের দর্শকের বদলে শহরের মানুষের মাঝে কাজ করতে তিনি বেশি ভালোবাসেন, যেখানে দর্শক আগে থেকে কিছুই জানে না। শিল্পচর্চার এই পথে ব্রোমসকে অনেক সময় আর্থিক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
এক বন্ধুর রেস্টুরেন্টে থালা-বাসন ধুয়েও তিনি কিছু দিন চালিয়েছেন। তবে বর্তমানে, মিতব্যয়ী জীবনযাপন এবং বিভিন্ন উৎস থেকে আসা সামান্য আয়ের মাধ্যমে, তিনি একটি স্থিতিশীল অবস্থানে পৌঁছেছেন। বর্তমানে তিনি লন্ডনে একটি পারফর্মেন্স আর্ট উৎসবে যোগ দিতে সেখানে গিয়েছেন।
গুস্তাফ ব্রোমস-এর মতে, ভাষা সব সময় সব কথা বলতে পারে না। তাঁর কাজের মূল বিষয় হলো ভাষার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা। তিনি মনে করেন, দুটি ভিন্ন জিনিসকে আমরা হয়তো ‘গ্লাস’ বলতে পারি, কিন্তু তারা আসলে একে অপরের থেকে আলাদা।
তাঁর মতে, অন্যান্য শিল্প মাধ্যমে আমরা আরো সুনির্দিষ্ট হতে পারি। ব্রোমস-এর জীবন সবসময়ই ছিল এক নতুন পথের সন্ধান। হয়তো এ কারণেই তাঁর কাজগুলো আজও দর্শককে নতুন করে ভাবতে শেখায়, শিল্পের সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলে।
তথ্য সূত্র: The Guardian