দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে নাৎসি জার্মানির কুখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা লেনি রিফেনস্টাহলের এক ভিন্ন রূপ উন্মোচন করা হয়েছে সম্প্রতি। আন্দ্রেআস ভাইয়েলের নতুন তথ্যচিত্র ‘রিফেনস্টাহল’-এ উঠে এসেছে কীভাবে রিফেনস্টাহল তাঁর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা গোপন করে শিল্পী হিসেবে পরিচিতি ধরে রেখেছিলেন।
ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর কাজের স্বীকৃতি ছিল, কিন্তু তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো নাৎসিবাদের প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
১৯৩২ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দ্য ব্লু লাইট’ দিয়ে যাত্রা শুরু হয় রিফেনস্টাহলের। এরপর ১৯৩৪ সালে নাৎসি পার্টির কংগ্রেসের ওপর নির্মিত তাঁর চলচ্চিত্র ‘ট্রায়াম্প অফ দ্য উইল’-এর জন্য তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৯৩৮ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসের ওপর নির্মিত দুই পর্বের তথ্যচিত্র ‘অলিম্পিয়া’র জন্য সেরা বিদেশি চলচ্চিত্র বিভাগে পুরস্কৃত হন। এই চলচ্চিত্রগুলো তৈরি ও অর্থায়নের পেছনে ছিল নাৎসি সরকার এবং এর তত্ত্বাবধানে ছিল রিচ মন্ত্রক।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রিফেনস্টাহল সবসময় নিজেকে একজন নির্দলীয় শিল্পী হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর দাবি ছিল, তিনি কেবল শিল্পের সৌন্দর্য ও সৃজনশীলতার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, বাস্তব জগতের সমস্যা নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না।
যদিও তিনি হিটলারের প্রতি ব্যক্তিগত আকর্ষণ অস্বীকার করেননি, তবে নাৎসি শাসনের ভয়াবহতার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা জোরালোভাবে অস্বীকার করেছেন।
নতুন তথ্যচিত্রটি রিফেনস্টাহলের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করেছে। এতে ৭০০টির বেশি বাক্সে চলচ্চিত্র, সংবাদ ক্লিপিং, চিঠি, ডায়েরি, ব্যক্তিগত ভিডিও, স্মৃতিকথার খসড়া, অসংখ্য টেলিফোন কথোপকথন এবং হাজার হাজার ছবি ছিল।
গবেষকদের একটি দল ছয় বছর ধরে এই উপাদানগুলো খুঁটিয়ে দেখেছে। প্রথমে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি। রিফেনস্টাহল যেন তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর ভাবমূর্তি রক্ষার কাজটি ভালোভাবে করে গেছেন।
তবে ধীরে ধীরে কিছু সূত্র পাওয়া যায়। একটি ডায়েরিতে ‘এনপিডি’-কে ভোট দেওয়ার কথা লেখা ছিল, যা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের একটি নব্য-নাৎসি দলের প্রতি ইঙ্গিত করে।
ব্যক্তিগত টেলিফোন কথোপকথনে নাৎসি শাসনের ‘নৈতিকতা ও গুণাবলী’র প্রতি নস্টালজিয়া প্রকাশ করা হয়েছে। ১৯৩৪ সালে ‘ডেইলি এক্সপ্রেস’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, হিটলারের ‘মেইন কাম্ফ’-এর প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহের কথা উল্লেখ ছিল।
এছাড়াও পাওয়া গেছে কিছু ব্যক্তিগত চিঠি, যেখানে ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে কোন্স্কিতে ইহুদিদের ওপর চালানো গণহত্যার ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। প্রথমে রিফেনস্টাহল ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত থাকার কথা অস্বীকার করেন, পরে জানান, তিনি সেখানে ছিলেন, তবে ঘটনার ভয়াবহতা দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন।
চিঠিতে গণহত্যার জন্য তাঁর পরোক্ষ নির্দেশনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
তথ্যচিত্রের পরিচালক আন্দ্রেআস ভাইয়েল জানান, প্রথমে তিনি রিফেনস্টাহলের দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু পরে বুঝতে পারেন, কাজটি তিনি নিজেই করেছেন। রিফেনস্টাহল কেবল একজন খারাপ মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মানুষ।
আর এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক। তথ্যচিত্রে রিফেনস্টাহলের শৈল্পিক দক্ষতার পাশাপাশি নাৎসিবাদকে মহিমান্বিত করার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অঙ্গভঙ্গি থেকে শুরু করে মস্কোর সামরিক কুচকাওয়াজ— সর্বত্রই ‘ট্রায়াম্প অফ দ্য উইল’-এর প্রভাব দেখা যায়।
ভাইয়েল মনে করেন, রিফেনস্টাহল তাঁর শৈশব এবং অভিনয় জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নাৎসিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে তিনি রিফেনস্টাহলের জীবনের অনেক অজানা দিক উন্মোচন করেছেন।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান