গাজায় ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা এক নারীর সন্তান হারানোর আর্তনাদ।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অবরোধের কারণে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা চরম দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। একদিকে যেমন খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব, তেমনই অন্যদিকে চিকিৎসা পরিষেবা কার্যত ভেঙে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সেখানকার অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। সম্প্রতি এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ইসরায়েলি বোমা হামলার মধ্যে এক নারী তাঁর সন্তানকে হারিয়েছেন। খবরটি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এপি।
ইয়াসমিন সিয়াম নামের ওই নারী বর্তমানে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। গাজার একটি শরণার্থী শিবিরে তিনি বসবাস করতেন।
ইসরায়েলি বিমান হামলার কারণে সবসময় আতঙ্কে থাকতেন। পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ায় তিনি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। গত এক মাস ধরে তিনি মাংস খাননি।
নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গেলেও তেমন কোনো সুরাহা হয়নি।
একদিন রাতে হঠাৎ তাঁর প্রসব বেদনা শুরু হয়। কিন্তু গুলির শব্দে ভীত হয়ে তিনি ঘর থেকে বের হতে পারেননি।
কোনোমতে ভোর হওয়ার পর নিকটস্থ একটি অস্থায়ী ক্লিনিকে যান। সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁকে খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে যেতে বলেন।
বোমা হামলায় বিধ্বস্ত রাস্তা দিয়ে একটি গাধার গাড়িতে চড়ে বহু কষ্টে তিনি হাসপাতালে পৌঁছান।
সেখানে ডাক্তাররা জানান, তাঁর সন্তানের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি, তবে তিনি অপুষ্টিতে ভুগছেন। তাঁর ওজন ছিল মাত্র ৫৭ কেজি।
চিকিৎসকেরা তাঁকে ভালো খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।
আমি নিজের জন্য চিন্তিত নই। আমি আমার সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন। তাকে হারালে আমার জীবনে নেমে আসবে চরম অন্ধকার।
গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের কারণে সেখানকার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য মাতৃত্ব এখন এক কঠিন সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, গাজায় প্রায় ৫৫ হাজার গর্ভবতী নারীর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছেন এবং অর্ধেকের বেশি নারী উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণের শিকার।
গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে অন্তত ২০ শতাংশ হয় অপরিণত অবস্থায় জন্মেছে, নয়তো অপুষ্টির শিকার হয়েছে।
নাসের হাসপাতালের চিকিৎসক ইয়াসমিন শনিয়ার মতে, সম্প্রতি প্রতি সপ্তাহে ৪০ জন নারীর গর্ভপাত হচ্ছে। যুদ্ধের আগে যেখানে প্রতি বছর ২ জন নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেতেন, সেখানে এখন প্রতি মাসে ৫ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।
ইয়াসমিনের স্বামী হোসেন সিয়াম জানান, তাঁদের বিয়ে হয়েছিল যুদ্ধের মধ্যেই। বিয়ের এক মাসের মধ্যেই ইয়াসমিন জানতে পারেন তিনি মা হতে চলেছেন।
তাঁদের পরিবারে আনন্দের ঢেউ লেগেছিল। কিন্তু যুদ্ধের কারণে ইয়াসমিনের স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে। পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের অভাবে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন।
ইসরায়েলের অবরোধের কারণে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীরও অভাব দেখা দিয়েছে। এমনকি শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ডায়াপারও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।
অনেক নারী পুরনো ডায়াপার ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন, যার ফলে তাঁদের ত্বকের বিভিন্ন রোগ হচ্ছে।
নাসের হাসপাতালের চিকিৎসক ড. আহমেদ আল-ফাররা জানান, হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় হাসপাতালের ইনকিউবেটরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বর্তমানে সেখানে অকাল জন্ম নেওয়া শিশুদের শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় সমস্যা হচ্ছে।
ডা. আল-ফাররা আরও জানান, যুদ্ধের কারণে শিশুদের নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন গুরুতর সংক্রমণ হচ্ছে, যা আগে খুব কম দেখা যেত।
গাজায় মানবিক সংকট কতটা তীব্র, তা ইয়াসমিন সিয়ামের এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট। খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার অভাবে সেখানকার নারীরা তাঁদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)