আর্টিস্ট ও ইতিহাসবিদদের প্রতি ট্রাম্পের ‘অপরাধমূলক’ কার্যক্রম রুখে দেওয়ার আহ্বান জানালেন পরিচালক অ্যাভা ডুভার্নে।
ওয়াশিংটন ডিসিতে সম্প্রতি, অস্কার-মনোনীত এবং এমি জয়ী পরিচালক অ্যাভা ডুভার্নে শিল্পী ও ইতিহাসবিদদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কার্যকলাপকে ‘অপরাধমূলক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। একইসঙ্গে, ইতিহাসের পুনর্লিখনের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আমেরিকান হিস্টোরিতে এক পুরস্কার গ্রহণকালে ডুভার্নে এই আহ্বান জানান। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে নির্মিত সেলমা-র মতো সিনেমার পরিচালক ডুভার্নে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন থেকে “অনুচিত, বিভেদ সৃষ্টিকারী বা আমেরিকান-বিরোধী” আদর্শ দূর করার উদ্দেশ্যে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করার প্রেক্ষাপটে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও, ট্রাম্প জন এফ কেনেডি সেন্টার ফর দ্য পারফর্মিং আর্টস-এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন এবং লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস কার্লা হ্যাডেনকে বরখাস্ত করেছেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ট্রাম্পের শিল্প ও সংস্কৃতির ওপর আঘাতের বিষয়ে উদ্বিগ্ন কিনা জানতে চাইলে ডুভার্নে বলেন, “অবশ্যই। তবে আমি এতে অবাক নই। যখন আপনি একজন অপরাধীকে নির্বাচিত করেন, তখন আপনি অপরাধ আশা করতেই পারেন।”
উল্লেখ্য, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রেসিডেন্ট, যিনি ২০১৮ সালে একজন পর্নো তারকার সঙ্গে সম্পর্ক গোপনের জন্য করা অর্থ প্রদানের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। ডুভার্নের মতে, ট্রাম্পের এই ধরনের কাজগুলো খুবই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, “আমি ইতিহাস অধ্যয়ন করি। তাই…”
ডুভার্নের অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে বর্ণগত অবিচার ও ব্যাপক কারাবাস নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র ‘১৩তম’ এবং ইতিহাসবিদ ইসাবেল উইলকারসনের বই ‘কাস্ট’ অবলম্বনে নির্মিত ‘অরিজিন’।
এই অনুষ্ঠানে, ডুভার্নে প্রথম পরিচালক, লেখক এবং প্রযোজক হিসেবে স্মিথসোনিয়ানের গ্রেট আমেরিকান মেডেল লাভ করেন। এই পুরস্কারটি আমেরিকান আদর্শ ও ধারণাকে প্রতিফলিত করে এমন আজীবন অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেওয়া হয়। এর আগে, এই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলিন অলব্রাইট, জেনারেল কলিন পাওয়েল, সঙ্গীতজ্ঞ পল সাইমন, চিকিৎসক অ্যান্টনি ফাউসি এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রুথ বাডার গিন্সবার্গ (মরণোত্তর)।
ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আমেরিকান হিস্টোরিতে দেওয়া ভাষণে ডুভার্নে সরাসরি ট্রাম্পের নাম উল্লেখ না করে স্মিথসোনিয়ানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে এমন একটি স্থান হিসেবে বর্ণনা করেছেন, “যা ইতিহাসের গুরুত্ব এবং তা ভালোভাবে বলার গুরুত্ব বোঝে।”
তিনি আরও বলেন, “এই উপলব্ধি এখন বিশেষভাবে জরুরি, যখন সত্যের পুনর্লিখনের চেষ্টা চলছে এবং ভীতি একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। আয়নার ভয়, স্মৃতির ভয়, জটিলতা ও ধ্বংসাত্মক বৈপরীত্যের মধ্যে সম্পূর্ণ আমেরিকান গল্প বলার ভয়।”
ক্যালিফোর্নিয়ার কমটনে বেড়ে ওঠা এই চলচ্চিত্র নির্মাতা যোগ করেন, “ইতিহাস কোনো অস্ত্র নয়, যা অসুবিধার সময় লুকিয়ে রাখা হবে। এটি ঘুমের জন্য বলা কোনো রূপকথাও নয়। এটি একটি গভীর এবং প্রায়শই অশান্ত নদী এবং স্মিথসোনিয়ান দীর্ঘদিন ধরে সেই সেতু হিসেবে কাজ করছে, যা আমাদের সাবধানে পার হতে সাহায্য করে। আমরা জানি, যা কিছু ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত আদর্শ হিসেবে লেবেল করা হয়, তা আসলে সংযোগ স্থাপনকারী। যা কিছুকে বিকৃত বলা হয়, তা কেবল একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যা দীর্ঘদিন ধরে চাপা ছিল, এখন উন্মোচিত হচ্ছে।”
ডুভার্নে তাঁর বক্তব্যে এমন একটি শিশুর কথা উল্লেখ করেন, যে স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরে প্রবেশ করে তার মা বা ঠাকুরমার মতো দেখতে একজন নারীর ছবি দেখে, যিনি প্রতিবাদে, প্রার্থনায় বা গর্বের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এমন শিক্ষকদের কথা বলেন, যারা তাদের ছাত্রদের এখানে নিয়ে আসেন, কারণ তাদের পাঠ্যপুস্তকগুলিতে রেডলাইনিং, তুলসা বা ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্প অথবা স্টোনওয়ালের কথা উল্লেখ নেই। তিনি আরও বলেন, “আসুন আমরা এমন একটি পরিবারের কথা বলি – শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী, অভিবাসী – যারা স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে এবং অনুভব করে যে এই দেশ অবশেষে তাদের স্থান দিতে পারে। এটি কোনো মতাদর্শ চাপানো নয়। এটি হলো আপন করে নেওয়া, শিক্ষা, এবং গণতন্ত্র।”
ডুভার্নে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে থাকা বৈপরীত্যের মোকাবিলা এবং এর কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো তুলে ধরার জন্য স্মিথসোনিয়ানের সেক্রেটারি লনি বাঞ্চের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, “কারণ, ইতিহাসে এমন কোনো সম্মান নেই যা নিজেকে খুশি করে। এমন কোনো স্মৃতির সততা নেই যা কেবল কিছু মানুষের কথা মনে রাখে এবং ভুলে যাওয়ার মধ্যে কোনো ভবিষ্যৎ নেই।”
যারা অবিচারের প্রতি চোখ বন্ধ করে, যারা আমাদের প্রবীণ, পূর্বপুরুষ, পণ্ডিত, শিল্পী এবং লেখকদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আমরা ভুলতে রাজি নই। আমরা স্মৃতির পরিবর্তে কোনো মিথ তৈরি করব না। আমরা আরামের জন্য সত্যকে বিকৃত করব না। বরং আমরা একত্র হব, স্মরণ করব, শেখাব, ভাগ করব এবং সবকিছু বলব। আসুন, আমরা এই ধারা বজায় রাখি এবং যারা অতীতের একটি সংকীর্ণ বিভাজনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে, তাদের মনে করিয়ে দিই যে ভবিষ্যৎ আমাদের সকলের।”
১৮৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত স্মিথসোনিয়ান বিশ্বের বৃহত্তম জাদুঘর, শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র। তবে, ট্রাম্পের মার্চ মাসে জারি করা নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে যে, এই প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি “একটি বিভেদ সৃষ্টিকারী, জাতি-কেন্দ্রিক আদর্শের প্রভাবে এসেছে” এবং তিনি ভাইস- প্রেসিডেন্ট জেডি ভেন্সকে এই বিষয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আমেরিকান হিস্টোরির পরিচালক আন্থিয়া হার্টিগ এক সাক্ষাৎকারে জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠান এখনো পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক চাপের সম্মুখীন হয়নি।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান