পর্তুগালের অনাবিষ্কৃত উপকূল: একটি আদর্শ পরিবার-বান্ধব ছুটি।
ছেলেটির চিৎকারে সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আমিও হেসে উঠলাম। “বাবা, এটা পৃথিবীর সেরা সমুদ্র সৈকত!” পর্তুগালের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল, যেখানে এখনো পর্যটকদের আনাগোনা তেমন বাড়েনি, তেমনই একটি জায়গায় আমাদের ছুটি কাটাতে আসা।
আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত এই অঞ্চলের একদিকে যেমন রয়েছে আলগার্ভের মতো কোলাহলপূর্ণ রিসোর্ট, তেমনই অন্য দিকে রয়েছে আলentejo-র রুক্ষ উপকূল। তবে এখানে প্রকৃতির এক অপূর্ব রূপ বিদ্যমান যা পরিবার নিয়ে ছুটি কাটানোর জন্য আদর্শ।
এই উপকূল জুড়ে রয়েছে নানা আকারের সমুদ্রসৈকত আর পাহাড়। এখানে ১৯৮ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ভিকেন্টাইন কোস্ট প্রাকৃতিক উদ্যান (Vicentine Coast natural park) উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফলে প্রকৃতির আসল রূপটি এখনো এখানে বিদ্যমান। এখানকার গ্রামগুলো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অথবা নদীগুলোর পাশে গড়ে উঠেছে। যারা হেঁটে পাহাড় এবং জঙ্গলের পথ ভালোবাসেন, তাদের জন্য এখানে রয়েছে ‘ফিশারম্যান’স ট্রেইল’ (Fisherman’s Trail) এবং ‘হিস্টোরিক্যাল ওয়ে’ (Historical Way)-এর মতো দীর্ঘ পথ।
আমরা সাধারণত সমুদ্রের ধারে কোনো অ্যাপার্টমেন্টে উঠি না, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। Praia de Monte Clérigo থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত Muxima নামের একটি পারিবারিক B&B-তে (Bed and Breakfast) উঠলাম।
আমাদের ইচ্ছে ছিল, নয় ও এগারো বছর বয়সী ছেলেরা এখানে অনেকটা সময় খোলা আকাশের নিচে খেলাধুলা করবে আর আমরা স্থানীয় ওয়াইন পান করতে করতে রোদ উপভোগ করব। B&B-তে পৌঁছেই আমরা বুঝলাম, আমাদের পছন্দ সঠিক ছিল।
Muxima-র মালিকের বারো বছর বয়সী ছেলে জ্যাকসন আমাদের কাছে এসে জানতে চাইল, “আপনারা কি আমার কাতানা দেখতে চান?” কাতানা (katana) হলো জাপানি তলোয়ার।
সৌভাগ্যবশত, এটা আসল তলোয়ার ছিল না। আমাদের ছেলেরা এখানে এসে খুব দ্রুত মিশে গিয়েছিল। B&B-টির সাতটি ঘর রয়েছে, যার প্রত্যেকটিই আলাদা।
আমাদের পারিবারিক স্যুইটটি ছিল অনেকটা ঐতিহ্যপূর্ণ। লাল ও হালকা হলুদ দেয়াল, খড়ের তৈরি বাতি এবং সিরামিকের ল্যাম্প দিয়ে ঘরটি সাজানো ছিল, যা পর্তুগালের চেয়ে উত্তর আফ্রিকার কথা মনে করিয়ে দেয়।
আলজেজুর (Aljezur) শহরের পুরনো দুর্গটি দশম শতকে আরবদের তৈরি করা। এখানকার প্রাকৃতিক সুইমিং পুলে সাঁতার কাটার পর আমরা ইউক্যালিপটাস গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছিলাম।
বড় ছেলেটি চিৎকার করে বলল, “চলো, ব্যাঙদের সাথে সাঁতার কাটি।” Muxima-র প্রাকৃতিক সুইমিং পুলটি সবসময় আমাদের আকর্ষণ করত।
এখানকার পুকুরে ব্যাঙের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। ছেলেরা আমাদের মুরগি, দোলনা এবং বনের ভেতরের একটি পথ দেখায়। তারা নাকি সেখানে একটি ঘাস-সাপও দেখেছে।
অন্যান্য অতিথিদের সাথে B&B-এর সাধারণ ঘরটিতে বসে আমরা গল্প করতাম। সেখানে স্থানীয় ওয়াইন ছিল, যা অতিথিরা নিজেরাই নিতে পারতেন।
এখানকার একটি পরিবার নিয়মিত আসে এবং তারা হাইকিং ও সার্ফিংয়ের (surfing) জন্য Muxima-কে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। তারা আমাদের মশার উপদ্রব সম্পর্কে সতর্ক করল।
এখানকার মালিক পাওলা আমাদের হাতে কিছু প্রাকৃতিক সিট্রোনেলা তেল তুলে দিলেন। Muxima-র পরিবেশ-বান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি তাদের প্রতিটি কাজে প্রকাশ পায়।
এখানে প্রতিদিন নিরামিষ ব্রেকফাস্টে পরিবেশিত হতো – আদা কেক, মুয়েসলি এবং ডিম। এছাড়াও, স্থানীয় শিল্পীদের তৈরি করা ছোট ছোট স্যুভেনিয়ারগুলো ছিল চমৎকার।
পর্তুগালের একটি দম্পতি ২০১১ সালে Muxima তৈরি করেন। ২০১৯ সাল থেকে ডাচ দম্পতি পাওলা এবং জেলের তত্ত্বাবধানে এটি পরিচালিত হচ্ছে, যারা অতিথিদের প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার সুযোগ করে দেন।
দিনের বেলা আমরা কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরে দেখতাম। ঢেউয়ের সাথে খেলা করার জন্য আমরা Praia da Arrifana-তে গিয়েছিলাম। সেখানে বডি বোর্ড (bodyboard) ভাড়া করে সার্ফিংয়ের চেষ্টা করলাম।
এরপর আমরা ক্লিফ-টপ রেস্টুরেন্ট O Paulo-তে বসে “cataplana de marisco” (ক্যাটাপ্লানা ডি মারিস্কো) ও বার্গার দিয়ে দুপুরের খাবার সেরেছিলাম। “Cataplana de marisco” পর্তুগালের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার, যা তাজা মাছ ও স্থানীয় মশলার সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়।
পরের দিন আকাশ মেঘলা ছিল, তাই আমরা একটি হাইকিং ট্রায়ালে (hiking trail) গিয়েছিলাম। Praia da Amoreira-র চার মাইল দীর্ঘ পথটিতে প্রজাপতি ও মাছরাঙা পাখির দেখা পাওয়া যায়।
আলজেজুরে ফিরে Arte Bianca-র পিৎজা খেয়ে আমাদের হাইকিংয়ের ক্লান্তি দূর হয়েছিল। এর পরের দিন, আমরা ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রান্ত Farol do Cabo de São Vicente-এর দিকে যাত্রা করি।
সেখানে Sagres-এর শান্ত সার্ফ টাউনে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করি।
চার দিনের মাথায়, ছেলেরা “proper surfing” করার জন্য বায়না ধরল। আমরা Soul & Surf-এর সাথে দুটি সার্ফিং ক্লাসের ব্যবস্থা করি।
আমাদের প্রশিক্ষক ব্রুনো (Bruno) Praia da Bordeira-র মতো একটি সুন্দর জায়গায় নিয়ে গেলেন। সেখানে সমুদ্রের ঢেউগুলোতে কিভাবে সার্ফিং করতে হয়, সেই বিষয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো।
ব্রুনো বলেছিলেন, “সার্ফিং মন ও শরীরের খেলা, এবং আমরা যদি শান্ত না থাকি, তবে ভালো করতে পারব না।”
ক্লাস শেষে ছেলেরা জানতে চাইছিল, “পরের সার্ফিং-এর ছুটিটা কবে?” নতুন বন্ধু তৈরি করা এবং নতুন কিছু শেখার মধ্যে দিয়ে আমাদের ছুটিটা দারুণভাবে কেটেছিল।
Muxima-র পারিবারিক স্যুইট, যেখানে ৪ জন থাকতে পারে, তার প্রতি রাতের ভাড়া প্রায় ২২,০০০ বাংলাদেশী টাকা থেকে শুরু।
Soul & Surf-এর প্রাইভেট সার্ফিং ক্লাসের জন্য জনপ্রতি প্রায় ৭,৫০০ বাংলাদেশী টাকা খরচ হয়।
তথ্য সূত্র: The Guardian