আন্দোলনকারীদের মধ্যে গুপ্তচরবৃত্তি: এক প্রতারণাপূর্ণ সম্পর্কের কাহিনি
ফেব্রুয়ারি ২০০৪, সময়টা তখন। কেট উইলসন (Kate Wilson), যিনি বন্ধুদের কাছে ‘কাতজা’ নামেই পরিচিত ছিলেন, তাঁর প্রেমিক মার্কের জন্য একটি ভালোবাসার কার্ড বানানোর কথা ভাবলেন। মার্ক ছিলেন খুবই আবেগপ্রবণ একজন মানুষ।
তিনি ভালোবাসার কবিতা লিখতেন, উপহার দিতেন, এমনকি টেক্সট মেসেজেও ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতেন। তাই কেটও চেয়েছিলো, ভালোবাসার এই দিনে মার্কের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে। কিন্তু এই কাজটি তাঁর জন্য সহজ ছিল না, কারণ তিনি ছিলেন কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের।
কিন্তু কেট জানতেন না, মার্ক নামের এই মানুষটি আসলে ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার, যিনি ছদ্মবেশে পরিবেশ আন্দোলনকারীদের দলে ঢুকেছিলেন। মার্কের আসল নাম ছিল মার্ক কেনেডি (Mark Kennedy)। কেট ও মার্কের মধ্যেকার ১৬ মাসের সম্পর্ককালে তাঁদের প্রতিটি কথা, একসঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত—সপ্তাহান্তের ছুটি কাটানো থেকে শুরু করে উপহার দেওয়া, দুপুরের আহার বা পারিবারিক অনুষ্ঠান—সবকিছুই মার্ক তাঁর হ্যান্ডলারকে (উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা) জানাতেন এবং তা নথিভুক্ত করা হতো।
ইকেয়াতে (Ikea) কেনাকাটা করতে যাওয়া থেকে শুরু করে কেটের পরিবারের সঙ্গে কাটানো সময়, এমনকি আয়ারল্যান্ডে ভ্রমণের জন্য কেনা একটি নতুন বাইসাইকেল—পুলিশের খাতায় সবই রেকর্ড করা হয়েছে। কেটের ঠাকুরমার মৃত্যুতেও মার্কের প্রতিক্রিয়া ছিল—অনুষ্ঠানটিতে যোগ না দেওয়ার জন্য অজুহাত তৈরি করা।
মার্ক কেনেডি, যিনি ‘অপারেশন পেঙ্গুইন’-এর (Operation Penguin) অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ আন্দোলনকারীদের দলে মিশে ছিলেন, আসলে ছিলেন একজন আন্ডার কভার পুলিশ অফিসার। তিনি অন্তত ১১ জন নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, যাদের কাছে তিনি ‘মার্ক স্টোন’ নামেই পরিচিত ছিলেন।
এই ঘটনার অনেক বছর পর, কেট জানতে পারেন মার্কের আসল পরিচয়। মার্কের অন্য এক প্রেমিকা তাঁর আসল পরিচয় জানতে পারেন, যখন তিনি মার্কের আসল পাসপোর্ট এবং তাঁর পরিবারের ছবি খুঁজে পান। এরপরই কেট জানতে পারেন, মার্ক আসলে একজন বিবাহিত পুলিশ অফিসার। এই ঘটনা কেটের জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। তিনি যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন, তা যেন হঠাৎ করেই এলোমেলো হয়ে যায়।
আন্দোলনকর্মী হিসেবে কেটের আন্ডার কভার পুলিশিং সম্পর্কে ধারণা ছিল, কিন্তু মার্কের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা তাঁর জন্য ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তাঁর ভাষায়, “আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় এমনটা ছিল না যে, একজন পুলিশ গুপ্তচর ছিল—এই কথা জানার পর আমি এত দুঃখ পাব। মনে হচ্ছিল, যেন সে (মার্ক) মারা গেছে—অথচ সে তো ছিলই না, সে কখনও ছিল না।
সে চলে গেছে, কিন্তু সে এখনো অন্য কোথাও ইন্টারভিউ দিচ্ছে।”
মার্ক কেনেডির এই প্রতারণার শিকার হওয়া নারীদের মধ্যে কেট ছিলেন অন্যতম। ঘটনার পর তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করেন। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই মামলায় পুলিশের গোপন নথিগুলো প্রকাশ্যে আসে, যেখানে মার্কের কার্যকলাপের বিস্তারিত বিবরণ ছিল।
২০২১ সালে, তদন্ত বিষয়ক ট্রাইব্যুনাল (Tribunal) ঘোষণা করে যে, ব্রিটিশ পুলিশ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এর ফলস্বরূপ, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
কেট উইলসন বর্তমানে একজন নার্স হিসেবে বিদেশে কাজ করছেন। এই ঘটনার পর তাঁর জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, “সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো—বিশ্বাস হারানোর যন্ত্রণা। অপরিচিতদের প্রতি অবিশ্বাস থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু কাছের মানুষদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা খুবই কঠিন। এটা কোনো না কোনোভাবে আমার জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে।”
বর্তমানে কেট আন্ডার কভার পুলিশিংয়ের শিকার হওয়া নারীদের নিয়ে কাজ করছেন এবং তাঁদের আইনি লড়াইয়ে সহায়তা করছেন।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান