মধ্যবয়সে ওজন কমালে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ভালো থাকতে পারে, এমনটাই জানাচ্ছে নতুন একটি গবেষণা। সম্প্রতি প্রকাশিত এই গবেষণা জানাচ্ছে, মাঝবয়সে শরীরের ওজন প্রায় ৬.৫ শতাংশ কমালে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুঁকি কমে আসে।
ফিনিল্যান্ডের হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের অধ্যাপক এবং এই গবেষণার প্রধান লেখক ড. টিমো স্ট্র্যান্ডবার্গ জানান, ওষুধ বা অস্ত্রোপচার ছাড়াই, শুধু খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চার মাধ্যমে ওজন কমালে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ওজন কমানোর ফলে সব ধরনের মৃত্যুর ঝুঁকিও কমে আসে।
গবেষণাটি মূলত তিনটি ভিন্ন সময়ের প্রায় ২৩,০০০ মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয়েছে। এই তিনটি দলের তথ্য ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ এবং ২০০০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছিল। গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদের বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) এবং ওজন কমার ধরনের ওপর ভিত্তি করে তাদের বিভিন্ন দলে ভাগ করেন। এরপর তাদের হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুর রেকর্ড পরীক্ষা করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, মাঝবয়সে যারা ওজন কমিয়েছেন, তাদের বার্ধক্যে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, অ্যাজমা (হাঁপানি) বা সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। শুধু তাই নয়, পরবর্তী ৩৫ বছরে তাদের যে কোনো কারণে মৃত্যুর সম্ভাবনাও হ্রাস পেয়েছিল।
তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে। গবেষণার অধিকাংশ ডেটা ওজন কমানোর ওষুধ বা অস্ত্রোপচারের ব্যাপক প্রচলনের আগে সংগ্রহ করা হয়েছিল। অর্থাৎ, এই স্বাস্থ্য উপকারিতা মূলত খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মতো জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স রবার্ট উড জনসন মেডিকেল স্কুলের ক্লিনিক্যাল গবেষক এবং মেডিসিনের শিক্ষক ড. আয়ুশ ভিসারিয়া এই গবেষণায় জড়িত না থেকেও এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, “এই গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ওজন কমানো এবং হৃদরোগ ও মৃত্যুর মধ্যে সম্পর্ক প্রমাণ করে। এই বিষয়টির ওপর আগে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি।”
গবেষণায় যদিও বৃহৎ সংখ্যক মানুষের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, তবুও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গবেষণাটি শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের ওপর করা হয়েছিল, যার কারণে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ক্ষেত্রে এই ফল কতটুকু প্রযোজ্য, তা বলা কঠিন। ড. ভিসারিয়ার মতে, “বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে বিএমআই-এর ভিন্নতা দেখা যায়।”
এছাড়াও, বিএমআই শরীরের গঠন পরিমাপের সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি নাও হতে পারে। কারণ, এটি উচ্চতার সঙ্গে ওজনের সম্পর্ক বিবেচনা করে, কিন্তু শরীরের হাড় ও পেশীর অনুপাত বিবেচনা করে না। ড. ভিসারিয়া আরও যোগ করেন, “এমন অনেক বিষয় আছে যা একজন ব্যক্তির শরীরের গঠনে পরিবর্তন আনতে পারে, যদিও তার ওজন খুব বেশি নাও বাড়তে পারে।”
অন্যান্য গবেষণা থেকে জানা যায়, শরীরের ফ্যাট বা চর্বি বিতরণের ধরনও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের চারপাশে জমে থাকা চর্বি রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
ওজন কমানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনও জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত শরীরচর্চা রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
ড. ভিসারিয়ার মতে, “গবেষণাটি পর্যবেক্ষণমূলক ছিল, অর্থাৎ ওজন কমানো এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাসের মধ্যে একটি সম্পর্ক দেখা গেছে। তবে, ওজন কমানোই যে ঝুঁকি কমানোর মূল কারণ, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।” গবেষকরা বয়সসহ অন্যান্য বিষয়গুলো বিবেচনা করেছেন, তবে খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক কার্যকলাপের মতো জীবনযাত্রার পরিবর্তনগুলো বিবেচনা করেননি।
ওজন কমানো এবং এর সঙ্গে জীবনযাত্রার পরিবর্তন—উভয়ই স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে পারে। ড. স্ট্র্যান্ডবার্গ উল্লেখ করেন, ওজন কমালে অস্টিওআর্থারাইটিস, স্লিপ অ্যাপনিয়া এবং ফ্যাটি লিভারের মতো সমস্যাগুলো কমে যায়। খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চার পরিবর্তনের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমানো সম্ভব।
তাহলে, কিভাবে এই পরিবর্তন আনা যায়? ড. ভিসারিয়ার মতে, স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত শরীরচর্চা চালিয়ে যাওয়া উচিত, এমনকি ওজন কমানোর ওষুধ খেলেও।
ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাস (Mediterranean diet) একটি ভালো উদাহরণ। এই খাদ্যাভ্যাসে ফল, সবজি, শস্য, জলপাই তেল, বাদাম ও বীজ-এর ওপর জোর দেওয়া হয়। গবেষণা বলছে, এই ধরনের খাবার বার্ধক্যে হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে, কিছু ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
শারীরিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বয়স্কদের প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতার ব্যায়াম অথবা ৭৫ মিনিট উচ্চ-তীব্রতার ব্যায়াম করার পরামর্শ দেয়। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন পেশী শক্তিশালী করার মতো ব্যায়াম করা উচিত।
ড. স্ট্র্যান্ডবার্গ আরও যোগ করেন, “স্থূলতা (obesity) শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি একটি কাঠামোগত সমস্যাও। আধুনিক সমাজে স্বাস্থ্যকর খাবার এবং শারীরিক কার্যকলাপের সুযোগ আরও বাড়ানো দরকার, যাতে স্থূলতার কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলো কমানো যায়।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন