মাখন: হাজার বছরের খাদ্যের এক আকর্ষণীয় ইতিহাস
প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত, মাখনের ব্যবহার বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রান্নায় এর স্বাদ এবং খাদ্যগুণ উভয়েরই জুড়ি মেলা ভার।
আমাদের দেশে যদিও মাখনের থেকে ঘিয়ের ব্যবহার বেশি, কিন্তু মাখনের ইতিহাসও কম চমকপ্রদ নয়। আসুন, মাখন নিয়ে কিছু মজাদার তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
প্রায় ৯,০০০ বছর আগে, মানুষেরা সম্ভবত অনিচ্ছাকৃতভাবে মাখন তৈরি করতে শুরু করে। যাযাবর সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন দুধের থলি ঘোড়ার পিঠে বেঁধে ভ্রমণ করত, তখন সেই দুধ নাড়াচাড়া হয়ে ঘন হয়ে মাখনে পরিণত হত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বুঝতে পারে, এই মাখন খাবারের স্বাদ বাড়াতে পারে।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, একসময় নরওয়ের প্রত্যেক বাড়িতে মাখন রাখাটা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। একাদশ শতাব্দীতে নরওয়ের রাজাকে বার্ষিক কর হিসেবে এক বালতি মাখন দিতে হতো!
তবে, মধ্যযুগে মাখনকে গরিব মানুষের খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সপ্তদশ শতাব্দীতে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের কাছেই এর কদর বাড়ে।
প্রাচীন রোমানরা অবশ্য মাখনকে তেমন গুরুত্ব দিত না, তারা এটিকে উত্তর দিকের বর্বরদের খাবার মনে করত।
তাদের ধারণা ছিল, মাখন শরীরে মালিশ করলে বিভিন্ন রোগ সারে।
মাখনের রং গরুর খাদ্যের ওপর নির্ভর করে। ঘাস-খাওয়া গরুর দুধে বিটা ক্যারোটিন বেশি থাকে, তাই তাদের মাখন গাঢ় হলুদ রঙের হয়।
অন্যদিকে, শস্য-খাওয়া গরুর মাখন হালকা রঙের হয়ে থাকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত মাখনে ৮০% ফ্যাট থাকে, যেখানে ইউরোপে এই পরিমাণ ৮২-৯০% পর্যন্ত হতে পারে।
এছাড়াও, আমেরিকার বাজারে ‘এএ’, ‘এ’, এবং ‘বি’ গ্রেডের মাখন পাওয়া যায়, যা তাদের স্বাদ এবং গঠনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়।
তিব্বতের উঁচু অঞ্চলের মানুষজন, রান্নার কাজে এবং ত্বককে ঠান্ডা থেকে রক্ষা করার জন্য ইয়াকের দুধ থেকে তৈরি মাখন ব্যবহার করে।
তারা এই মাখন চা-এর সাথে মিশিয়েও পান করে।
ভারতে মাখন উৎপাদন সবচেয়ে বেশি, যেখানে বছরে প্রায় ৬৯ লক্ষ মেট্রিক টন মাখন তৈরি হয়।
অন্যদিকে, নিউজিল্যান্ডের মানুষজন সবচেয়ে বেশি মাখন ব্যবহার করে, যা মাথাপিছু বছরে প্রায় ৬ কেজি।
মাখনের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমনই এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা সংস্কৃতি ও লোককথা।
প্রচলিত আছে, প্রাচীনকালে, ডাইনিরা নাকি মাখন এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত দ্রব্য চুরি করার জন্য পাখির রূপ ধারণ করত!
মাখনের উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিলে, অনেক দেশ, যেমন কানাডা এবং পোল্যান্ড, তাদের জাতীয় মাখন ভাণ্ডার থেকে সরবরাহ করে, যাতে দাম স্থিতিশীল থাকে।
ন্যাপোলিয়ন তৃতীয় খাদ্য সংকটের সময় মাখনের বিকল্প আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন।
১৮৬৯ সালে, ফরাসি রসায়নবিদ হিপোলাইট মেজ-মোরি গরুর মাংসের ফ্যাট এবং দুধ মিশিয়ে মার্জারিন তৈরি করেন।
আয়ারল্যান্ডে অতিরিক্ত মাখন সংরক্ষণের জন্য বোগ-এ পুঁতে রাখার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল।
বোগের কম অক্সিজেন এবং অ্যাসিডের কারণে মাখন সহজে নষ্ট হতো না। কয়েক হাজার বছর পরও কৃষকেরা মাঝে মাঝে এই ধরনের কাঠের ব্যারেল খুঁজে পান।
ক্যাথলিক চার্চে একসময় লেন্ট সময়ে মাখন খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, কারণ তারা মনে করত, এটি মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
তবে, ১৫শ শতাব্দীতে, চার্চকে কিছু অর্থ প্রদানের বিনিময়ে লেন্টেও মাখন খাওয়ার অনুমতি পাওয়া যেত।
সুতরাং, মাখনের উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে এর বিবর্তন, খাদ্য হিসাবে এর গুরুত্ব, বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার এবং সংরক্ষণের পদ্ধতি – সবই অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
খাদ্যরসিকদের জন্য মাখন তাই এক অপরিহার্য উপাদান, যা যুগ যুগ ধরে মানুষের খাদ্যাভ্যাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
তথ্য সূত্র: Travel and Leisure