হারানো ভাইয়ের জন্য সতেরো বছর ধরে অপেক্ষা, অবশেষে মিলল উত্তর: শিকাগোতে আত্মহত্যা, কান্না পরিবারের।
২০০৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর, পুয়ের্তো রিকোর বাসিন্দা ২৩ বছর বয়সী জ্যাঁ এলিয় গঞ্জালেজ তার মাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে তিনি নিরাপদে শিকাগোতে পৌঁছেছেন। এরপর আর কোনো দিন তার সাথে মায়ের কথা হয়নি।
প্রায় দুই দশক পর, গঞ্জালেজের পরিবার, যারা দীর্ঘদিন ধরে উত্তরহীন প্রশ্নের সঙ্গে লড়াই করে আসছিলেন, অবশেষে জানতে পারলেন তাদের প্রিয়জনের ভাগ্যে কি ঘটেছিল।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০২৩ সালে কুক কাউন্টি মেডিকেল পরীক্ষকের কার্যালয় (চিকিৎসা বিষয়ক সরকারি বিভাগ) একটি পুরনো মামলার অনুসন্ধানে নামে। সেই সময় ন্যাশনাল মিসিং অ্যান্ড আনআইডেন্টিফাইড পারসনস সিস্টেম (NamUs)-এ গঞ্জালেজের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ, অবশেষে পরিবার জানতে পারে যে তাদের আদরের ছেলে ও ভাই, জ্যাঁ, ২০০৭ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন।
পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৭ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর, শিকাগোর ড্যান রায়ান এক্সপ্রেসওয়ের কাছে একটি রেল ইয়ার্ডের বিলবোর্ডে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে জানা যায় তিনি হতাশায় ভুগছিলেন।
“এখন আমরা জানতে পেরেছি তিনি কোথায় মারা গেছেন এবং তাকে বিদায় জানাতে পারবো, এতেই আমাদের শান্তি,” – সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন গঞ্জালেজের বোন ভিলমারিলিস হার্নান্দেজ।
তবে তার মনে এখনো অনেক প্রশ্ন। গঞ্জালেজ ছিলেন একজন দয়ালু মানুষ।
তিনি অন্যের জন্য লড়াই করতে পিছপা হতেন না। ভিলমারিলিস তার একটি ঘটনা মনে করেন। যখন তার ভাই ১৫ বছর বয়সী ছিলেন, তখন তিনি সান লরেঞ্জোতে কয়েকজন শিক্ষার্থীর উপর হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
এক পর্যায়ে পকেট ছুরি দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছিল এবং হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।
ভিলমারিলিস বলেন, “আমার ভাই দেখত কেউ কিছু করছে না, তখন সে এগিয়ে যেত। এমন ছিলেন আমার ভাই।
তবে গঞ্জালেজের ব্যক্তিগত জীবনে কিছু সমস্যা ছিল। তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন এবং একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি হওয়ার জন্য শিকাগোতে যান।
স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তিনি ‘সেগুন্ডা ভিদা’ নামক এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যাপারে জানতে পারেন। তার মায়ের কাছে এখনো সেই কেন্দ্রের ব্রোশার রয়েছে। (বর্তমানে এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে)।
গঞ্জালেজ শিকাগোতে পৌঁছানোর এক সপ্তাহ পর, ভিলমারিলিসের একটি দুঃস্বপ্ন হয়। “সে আমাকে বিমানবন্দরে বলছিল, ‘চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’” ভিলমারিলিস বলেন, “আমি ধরে নিয়েছিলাম এটা বিদায় বলার মতো।
ঘুম থেকে উঠেই ভিলমারিলিস কাঁদতে শুরু করেন এবং মাকে ফোন করে দ্রুত পুনর্বাসন কেন্দ্রে ফোন করতে বলেন। মায়ের ফোন ধরেন সেখানকার একজন কর্মচারী এবং জানান যে তারা গঞ্জালেজের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না।
ভিলমারিলিস জানান, কেন্দ্র থেকে তাদের আর ফোন করা হয়নি। কয়েক দিন পর, ওই কর্মচারী জানান গঞ্জালেজ কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেছেন।
এরপর শুরু হয় পরিবারের আকুল প্রতীক্ষা। ভিলমারিলিস শিকাগো পুলিশ বিভাগ, স্থানীয় হাসপাতাল এবং আশ্রয়কেন্দ্রে ফোন করতে থাকেন। তিনি নিখোঁজ ডায়েরি করতে চাইলেও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাননি।
দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে বছর পার হয়ে যায়, কিন্তু তাদের চেষ্টা চলতেই থাকে।
কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “হয়তো সে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়নি। হয়তো আমাদের উপর রাগ করেছিল। সে কি লজ্জিত ছিল? তার কি শীত লেগেছিল, নাকি সে ক্ষুধার্ত ছিল?”
অবশেষে, ২০২৩ সালে তারা জানতে পারেন গঞ্জালেজের মৃত্যুর খবর।
কুক কাউন্টি মেডিকেল পরীক্ষকের কার্যালয় ১৯৮৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়নি এমন মৃত ব্যক্তিদের পুরনো নথিগুলো NamUs-এ অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে।
কুক কাউন্টির একজন মুখপাত্র জানান, “আমাদের কর্মীরা এই মৃত ব্যক্তিদের ডিএনএ বিশ্লেষণ, আঙুলের ছাপ এবং ডেন্টাল তথ্য অনুসন্ধানের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।
এখন পর্যন্ত NamUs-এ ২০০ জনের বেশি মানুষের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ২০টি মামলার সমাধান হয়েছে, যার মধ্যে গঞ্জালেজের ঘটনাও একটি।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম জানায়, গঞ্জালেজের মামলাটি NamUs-এ অন্তর্ভুক্ত করার পর ভিলমারিলিস ফেসবুকে তার ছবি দেখতে পান।
ছবিগুলো সেই সব মায়েদের একটি গ্রুপ শেয়ার করেছিল, যারা তাদের নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে চায়। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য শিকাগোতে যাওয়ার পর গঞ্জালেজের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়।
পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের দুঃখ আরও বাড়ে। তারা জানতে পারেন, গঞ্জালেজের মৃতদেহের সঙ্গে হাতে লেখা একটি স্প্যানিশ ভাষার চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল, যাতে ‘সেরেনিটি প্রেয়ার’ লেখা ছিল।
পুলিশের রিপোর্টে মৃতের নামের স্থানে তার নাম লেখা হয়েছিল।
তবে, ঘটনার তদন্তে গাফিলতি ছিল বলে অভিযোগ করেন ভিলমারিলিস। তিনি বলেন, “আমি তাদের আমার ভাইয়ের বর্ণনা দিয়েছিলাম এবং বছরের পর বছর ধরে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছি।
চিকাগো পুলিশ বিভাগ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। এমনকি কুক কাউন্টি মেডিকেল পরীক্ষকের কার্যালয়ও গঞ্জালেজের মামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে অস্বীকার করে।
ভিলমারিলিস ও তার বোন গঞ্জালেজের দেহাবশেষ সংগ্রহ করতে পারেননি। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে তাকে হোমউড মেমোরিয়াল গার্ডেন্সে সমাধিস্থ করা হয়েছে, যা কুক কাউন্টির অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহদের জন্য একটি স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তবে গঞ্জালেজের পরিবার একটি অনুদান সংগ্রহ শুরু করেছে, যাতে তার জন্য একটি উপযুক্ত স্মৃতিফলক তৈরি করা যায়। বোনেরা ‘আমরা তোমাকে খুঁজে পেয়েছি’ লেখা টি-শার্ট তৈরি করেছেন এবং তারা তার সমাধিতে যেতে চান।
ভিলমারিলিস বলেন, “আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন আমরা সেখানে গিয়ে তাকে শেষ বিদায় জানাতে পারব।”
তথ্য সূত্র: পিপলস