চীনের বিশাল বনভূমি: বিশ্বকে তাক লাগানো জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থা।
চীন খুব দ্রুত গতিতে তার জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থার বিস্তার ঘটাচ্ছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ তারা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বড় একটি জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থা তৈরি করতে চায়।
ধারণা করা হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে চীনের প্রায় ৪৯টি জাতীয় উদ্যান তৈরি হবে, যার আয়তন হবে প্রায় ২৭ কোটি ২০ লক্ষ একর। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় উদ্যানগুলোর সম্মিলিত আয়তন এর চেয়ে তিনগুণ কম।
চীনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুধু আকারের দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর পেছনের কারণগুলোও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা এবং স্থানীয় অর্থনীতির উন্নতি—এসবই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।
চীনের এই জাতীয় উদ্যানগুলোতে রয়েছে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। আল্পীয় পর্বতমালা থেকে শুরু করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃষ্টি বন, দুর্গম হিমবাহ এবং বিস্তৃত মরুভূমি—সবই এখানে দেখা যায়। এই উদ্যানগুলো বিরল প্রজাতির প্রাণী যেমন—বিশাল আকৃতির পান্ডা, সাইবেরিয়ান বাঘ এবং এশীয় হাতির আবাসস্থল।
চীনের সরকার মনে করে, এই উদ্যানগুলো স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা করতে সহায়তা করবে। যদিও বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের মধ্যে চীনের ঐতিহাসিক শহরগুলোর প্রতি আকর্ষণ বেশি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থার প্রসারের সাথে সাথে প্রকৃতি-কেন্দ্রিক পর্যটনেও চীন বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন এই ক্ষেত্রে অন্যদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারবে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েলোস্টোন মডেলের ভুলগুলো এড়িয়ে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রকৃতির একটি ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে চীন।
এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও রক্ষা করা সম্ভব হবে।
চীনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক নিচে তুলে ধরা হলো:
১. জায়ান্ট পান্ডা ন্যাশনাল পার্ক (Giant Panda National Park):
সেন্ট্রাল চীনের সিচুয়ান, শানসি এবং গানসু প্রদেশে অবস্থিত এই পার্কটি প্রায় ৬৬ লক্ষ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে চীনের অন্যতম আকর্ষণীয় প্রাণী—বিশাল আকৃতির পান্ডাদের দেখা পাওয়া যায়।
এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এই পার্ক পরিদর্শনের উপযুক্ত সময়। দর্শনার্থীরা এখানে পান্ডাদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখতে পারেন এবং তাদের সম্পর্কে জানতে পারেন।
২. উত্তর-পূর্ব চীন বাঘ ও চিতাবাঘ জাতীয় উদ্যান (Northeast China Tiger and Leopard National Park):
এই পার্কটি চীনের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এবং রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি প্রায় ৩৫ লক্ষ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে। এই পার্কটি বিরল প্রজাতির আমুর বাঘ এবং আমুর চিতা সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. সানজিয়াংইউয়ান জাতীয় উদ্যান (Sanjiangyuan National Park):
চীনের সবচেয়ে বড় এই পার্কটি ফ্লোরিডার চেয়েও বড়, যার আয়তন প্রায় ৪ কোটি ৭০ লক্ষ একর। এটি চীনের ‘জল-স্তম্ভ’ নামে পরিচিত, কারণ এখান থেকেই ইয়াংসি, মেকং এবং ইয়েলো নদীর উৎপত্তি হয়েছে।
এখানকার মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তিব্বতি হরিণ এবং তুষার চিতার মতো দুর্লভ প্রাণীরও এখানে দেখা মেলে।
৪. হাইনান ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্ট জাতীয় উদ্যান (Hainan Tropical Rainforest National Park):
চীনের হাইনান প্রদেশের প্রায় ১০ লক্ষ একর জায়গা জুড়ে এই পার্কটি অবস্থিত। একে চীনের ‘হাওয়াই’ বলা হয়।
এখানে চীনের সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং ভালোভাবে সংরক্ষিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃষ্টি বন রয়েছে। এই বনে সরীসৃপ, পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর অনেক প্রজাতি বাস করে।
৫. উয়ি পর্বত জাতীয় উদ্যান (Wuyi Mountain National Park):
ফুজিয়ান এবং জিংসি প্রদেশের প্রায় ৩ লক্ষ ১৬ হাজার একর জায়গা জুড়ে এই পার্কটি অবস্থিত। এখানকার লাল পাথরের পাহাড়, গিরিখাত এবং সবুজ বনভূমি পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে।
চীনের এই জাতীয় উদ্যানগুলো আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা (International Union for Conservation of Nature – IUCN)-এর মানদণ্ড মেনেই তৈরি করা হচ্ছে।
এর ফলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, পরিবেশের সুরক্ষা এবং পর্যটনের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয়। আমাদের দেশেও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং পরিবেশ সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
চীনের এই ধরনের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করে, আমরাও আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে পারি এবং পরিবেশ-বান্ধব পর্যটনের প্রসার ঘটাতে পারি।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক