প্রায় এক দশক আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন, তখন অনেকেই একে নিছক একটি কৌতূহল হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি শুধু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হননি, বরং দেশটির রাজনৈতিক দৃশ্যপটও সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছেন।
ট্রাম্পের এই পরিবর্তনের ঢেউ এখনো পর্যন্ত দেশটির রাজনীতিতে লেগে আছে, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। আসুন, সেই পরিবর্তনের কয়েকটি প্রধান দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।
প্রথমত, রিপাবলিকান পার্টির ঐতিহ্যবাহী রক্ষণশীলতার পরিবর্তন ঘটেছে। একসময়কার রিপাবলিকান পার্টি এবং বর্তমানের মধ্যে অনেক পার্থক্য তৈরি হয়েছে।
তারা এখন রোনাল্ড রিগ্যানের আদর্শ থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছে। অর্থনৈতিক নীতি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, সত্যের অবমূল্যায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ট্রাম্পের সময়ে মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ি ছিল, যা এখন আর তেমন আলোচনার বিষয় নয়।
ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, তার প্রথম মেয়াদে তিনি ৩০,০০০-এর বেশি মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন। যা প্রমাণ করে, প্রতিদিন গড়ে তিনি প্রায় একটি করে মিথ্যা বলেছেন। এমনকি, তার উপদেষ্টারাও ‘বিকল্প সত্য’-এর ধারণা দিয়েছেন, যা পরবর্তীতে তার সমর্থক মহলে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
তৃতীয়ত, ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিস্তার ঘটেছে। ট্রাম্প তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্মস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে।
এরপর বিভিন্ন সময়ে তিনি অসংখ্য ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়েছেন। তার সমর্থকরাও এখন এসব তত্ত্বে বিশ্বাসী। এর ফলস্বরূপ, ২০২০ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে, যা ৬ জানুয়ারি, ২০২১-এ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে হামলার কারণ হয়।
চতুর্থত, ডেমোক্রেটদের দুর্বলতা বেড়েছে। ট্রাম্পের সময়ে ডেমোক্রেট দল তাদের নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে।
তারা এমন সব প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে, যারা তেমন প্রভাবশালী ছিলেন না। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারাও ট্রাম্পের নতুন রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি, ল্যাটিনো এবং কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে তাদের সমর্থন কমেছে।
পঞ্চমত, আইন প্রণয়নের দুর্বলতা ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন বেড়েছে। ট্রাম্পের সময়ে কংগ্রেস কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছিল।
অনেক ক্ষেত্রে আইনসভা কোনো পদক্ষেপ নিতে চায়নি, আবার কখনো ট্রাম্পের ইচ্ছানুসারে কাজ করেছে। এমনকি, কংগ্রেসের ক্ষমতা খর্ব করে ট্রাম্প নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন।
এর ফলস্বরূপ, তার প্রথম ১০০ দিনে তিনি খুবই কম সংখ্যক বিল স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে নির্বাহী আদেশের সংখ্যা ছিল রেকর্ড পরিমাণে।
ষষ্ঠত, কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনীতির উত্থান হয়েছে। ট্রাম্পের সময়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রবণতা বেড়েছে।
তার সমর্থকরা এখন সরকারের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে কেন্দ্রীভূত করার পক্ষে মত দেয়। এমনকি, আদালত বা কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের চেয়েও তারা প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
সপ্তমত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাহীনতা বেড়েছে। ট্রাম্প তার দল ও সমর্থকদের মধ্যে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করেছেন।
এর মধ্যে রয়েছে গণমাধ্যম, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য। তিনি প্রায়ই এসব প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করেছেন এবং নিজের প্রতি আনুগত্য তৈরি করেছেন।
অষ্টমত, ভয়ের বিস্তার ঘটেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা এখন একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্রাম্পের সময়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে এবং অনেকে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। এমনকি, রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতি মানুষের সহনশীলতা বেড়েছে।
নবম, শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভাজন বেড়েছে। ডেমোক্রেটরা এখন শিক্ষিত মানুষের দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, যেখানে রিপাবলিকানরা মূলত শ্রমিক শ্রেণির সমর্থন লাভ করেছে।
কলেজ ডিগ্রি নেই এমন ভোটাররা এখন রিপাবলিকানদের দিকে ঝুঁকছে, যেখানে উচ্চশিক্ষিতরা ডেমোক্রেটদের সমর্থন করছে।
সবশেষে, অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে সামনে এসেছে। ট্রাম্প অভিবাসনকে কেন্দ্র করে কঠোর নীতি গ্রহণ করেন।
তিনি অভিবাসীদের সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন এবং অভিবাসন বিরোধী মনোভাব তৈরি করেছেন। অভিবাসন বিতর্ক এখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই পরিবর্তনগুলো আমেরিকার রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই প্রভাবগুলো এখনো বিদ্যমান এবং দেশটির ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তথ্য সূত্র: CNN