আমাদের স্মৃতিশক্তি: অতীতের ভান্ডার নাকি ভবিষ্যতের নির্মাতা?
স্মৃতি মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের উপলব্ধি এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা—সবকিছুই আমাদের স্মৃতির ওপর নির্ভরশীল। স্মৃতি শুধু অতীতের কিছু ঘটনার সংগ্রহশালা নয়, বরং এটি আমাদের চিন্তা, কল্পনা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতারও ভিত্তি।
সম্প্রতি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খ্যাতিমান মনোবিজ্ঞানী, ড্যানিয়েল শ্যাকটার, স্মৃতি নিয়ে নতুন কিছু ধারণা দিয়েছেন। তাঁর গবেষণায় স্মৃতি এবং কল্পনার মধ্যে গভীর সম্পর্ক উন্মোচিত হয়েছে, যা আমাদের মনকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
ড. শ্যাকটার দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে মানুষের স্মৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর মতে, স্মৃতি হলো একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে থাকে। এই স্মৃতি শুধু অতীতের ঘটনার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এটি আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের ধারণা তৈরি করতেও সাহায্য করে।
তাঁর গবেষণার মূল বিষয় হলো, আমরা কীভাবে অতীতের স্মৃতি ব্যবহার করে ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করি এবং কল্পনা করি।
শ্যাকটারের মতে, মানুষের স্মৃতি তৈরি হয় ‘গঠনমূলক এপিসোডিক সিমুলেশন’-এর মাধ্যমে। ‘এপিসোডিক’ স্মৃতি হলো আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা ঘটনার স্মৃতি, যা আমরা মনে করি।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, যখন আমরা কোনো ঘটনা মনে করি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক সেই ঘটনার বিভিন্ন অংশ একত্রিত করে, যা অনেকটা খেলার মতো। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি একটি সমুদ্র ভ্রমণের কথা মনে করেন, তবে আপনার মস্তিষ্ক সমুদ্রের দৃশ্য, বাতাসের অনুভূতি, বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের কথা—এগুলো একত্রিত করে একটি সম্পূর্ণ চিত্র তৈরি করবে।
ড. শ্যাকটার এবং তাঁর সহকর্মীরা মস্তিষ্কের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য fMRI (functional magnetic resonance imaging) ব্যবহার করেন। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে তাঁরা দেখেছেন যে, যখন আমরা অতীতের কোনো ঘটনা স্মরণ করি বা ভবিষ্যতের কোনো ঘটনার কল্পনা করি, তখন মস্তিষ্কের একই অঞ্চল সক্রিয় হয়।
এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে স্মৃতি এবং কল্পনা—দুটোই মস্তিষ্কের একটি সাধারণ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে।
ড. শ্যাকটারের গবেষণায় স্মৃতিভ্রংশ রোগীদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অতীতের অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না।
তবে তাঁদের ওপর করা কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে, তাঁরা সচেতনভাবে কোনো কিছু মনে করতে না পারলেও, অতীতের কিছু ঘটনার প্রভাব তাঁদের মধ্যে থাকতে পারে।
স্মৃতি নিয়ে গবেষণাকালে বিজ্ঞানীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবিষ্কার করেছেন, যা ‘সোর্স অ্যামনেসিয়া’ নামে পরিচিত। এর অর্থ হলো, কোনো ব্যক্তি একটি তথ্য কোথা থেকে পেয়েছেন, তা মনে রাখতে পারেন না।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্যক্তিকে বলা হয়, “বব হোপের বাবা ছিলেন একজন দমকলকর্মী”, তবে কয়েকদিন পর তিনি হয়তো বলবেন, “আমি শুনেছি বব হোপের বাবা একজন দমকলকর্মী ছিলেন।” কিন্তু তিনি বলতে পারবেন না যে, তিনি এই তথ্যটি কার কাছ থেকে শুনেছেন বা কোথায় পড়েছেন।
বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে আমাদের স্মৃতিশক্তির ওপর কিছু প্রভাব পড়ছে। আমাদের স্মার্টফোনগুলি প্রতিনিয়ত ছবি এবং তথ্যের মাধ্যমে অতীতের স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দেয়।
ড. শ্যাকটার মনে করেন, এর ফলে একদিকে যেমন স্মৃতিগুলো শক্তিশালী হয়, তেমনি এর কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। কারণ, প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া তথ্য সবসময় সম্পূর্ণ নাও হতে পারে, যা স্মৃতিকে বিকৃত করতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। ড. শ্যাকটার মনে করেন, মানুষের স্মৃতি এবং AI-এর মধ্যে কিছু মিল রয়েছে।
বিশেষ করে, AI তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সময় মানুষের মতোই কিছু ভুল করতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, AI-এর গভীর কাঠামো এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি।
তবে, মানুষের স্মৃতি এবং AI-এর মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ড. শ্যাকটারের মতে, স্মৃতি হলো একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। এই গবেষণা ভবিষ্যতে আমাদের স্মৃতিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে এবং আমাদের জীবনকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক