পশ্চিম লন্ডনের একটি অভিজাত যোগা সেন্টারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক ভয়ঙ্কর সত্যের উন্মোচন হয়েছে।
“তারা যোগা সেন্টার” নামের এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন রুমানিয়ার বিতর্কিত এক গুরু, গ্রেগোরিয়ান বিভোলারু। সম্প্রতি, এই যোগা সেন্টারের সঙ্গে জড়িত নারী ও পুরুষদের উপর যৌন নির্যাতন, প্রতারণা এবং মানব পাচারের অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনার সূত্রপাত হয় ২০১৫ সালে, যখন মিরান্ডা নামের এক তরুণী, যিনি পেশায় একজন শিক্ষক, যোগাভ্যাস শুরু করেন। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য যোগা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। মিরান্ডা জানান, নিয়মিত যোগা করার ফলে তিনি মানসিক শান্তি খুঁজে পান এবং জীবনের কঠিন পরিস্থিতিগুলো সহজে মোকাবেলা করতে সক্ষম হন। এরপর তিনি “তান্ত্রিক যোগা” নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন এবং থাইল্যান্ডে একটি কোর্সে অংশ নেন। দেশে ফিরে তিনি “তারা যোগা সেন্টার”-এর সন্ধান পান, যেখানে “এসোটারিক তন্ত্র” শেখানো হতো।
মিরান্ডা ধীরে ধীরে এই যোগা সেন্টারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সেখানে তিনি বন্ধুভাবাপন্ন, বুদ্ধিদীপ্ত এবং মুক্তমনা মানুষের দেখা পান। ২০১৮ সালের দিকে, একটি যোগা রিট্রিটে অংশ নেওয়ার পর তার জীবনে আসে এক নতুন মোড়। সেখানে তিনি গভীর ধ্যানে মগ্ন হতেন এবং অন্যদের নগ্ন হয়ে বিভিন্ন পারফর্মেন্স করতে দেখতেন। যদিও নগ্নতাকে তিনি সমর্থন করেননি, কিন্তু এই পরিবেশ তাকে আকৃষ্ট করে।
রিট্রিটের পর মিরান্ডা এক শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান এবং “তারা যোগা”-র অভ্যন্তরীণ মহলে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি বিভোলারু এবং তার সংগঠন “মুভমেন্ট ফর স্পিরিচুয়াল ইন্টিগ্রেশন ইনটু দ্য অ্যাবস্যুলিউট” (Misa)-র কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে পারেন। বিভোলারু ছিলেন ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায়। তার বিরুদ্ধে ছিল যৌন শোষণ ও মানব পাচারের অভিযোগ। বিভোলারু’র নির্দেশনায় নারীদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হতো।
মিরান্ডাকে জানানো হয়েছিল, বিভোলারুর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো আসলে রোমানীয় সরকারের ষড়যন্ত্র। এরপর তিনি বিভোলারুর সঙ্গে দেখা করার জন্য প্যারিসে যান। সেখানে তাকে একটি গোপন স্থানে আটকে রাখা হয়। বিভোলারু’র সঙ্গে তার “দীক্ষা” সম্পন্ন হয়, যা ছিল যৌন সম্পর্ক স্থাপনের একটি প্রক্রিয়া। বিভোলারু মিরান্ডাকে যৌন নির্যাতনের শিকার বানান। এরপর তাকে প্রাগে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাকে পর্ন সাইটে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
ভুক্তভোগী নারীদের অভিযোগ, বিভোলারু এবং তার অনুসারীরা তাদের বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করতেন এবং অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবহার করতেন। তারা নারীদের বলতেন, এই কাজগুলো তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য জরুরি।
যোগা গুরুদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে, শ্রী কে. পট্টাভি জয়েস এবং বিক্রম চৌধুরীর মতো প্রভাবশালী যোগা গুরুদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ উঠেছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, যোগা প্রশিক্ষকরা তাদের কর্তৃত্বের সুযোগ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শোষণ করেন। কারণ, যোগা প্রশিক্ষণের কোনো সরকারি নিয়ম না থাকায়, যে কেউ সহজেই যোগা শিক্ষক হতে পারেন।
বর্তমানে, মিরান্ডা এবং আরও কয়েকজন নারী বিভোলারু ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন। ফ্রান্সে বিভোলারুকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তার বিচার চলছে। যুক্তরাজ্যে, তারা যোগা সেন্টারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করেছেন।
এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আধ্যাত্মিকতার নামে অন্ধভাবে কোনো গুরু বা প্রতিষ্ঠানের উপর বিশ্বাস করা উচিত নয়। কোনো যোগা সেন্টারে যোগ দেওয়ার আগে, সেই প্রতিষ্ঠানের অতীত এবং শিক্ষকদের সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া, কর্তৃপক্ষের কাছে যোগা প্রশিক্ষকদের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে ভুক্তভোগীরা তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান