পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানার একটি উপকূলীয় জনপদ, অ্যাগাভেডজি। এই জনপদের বাসিন্দাদের জীবন এখন সমুদ্রের রুদ্র রূপের শিকার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী ঢেউয়ের কারণে এখানকার ভূমি ভাঙছে, ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যাচ্ছে, আর বাস্তুহারা হচ্ছেন মানুষ। সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার সাহায্য চেয়েও কোনো ফল হয়নি।
গত কয়েক সপ্তাহে ঢেউয়ের আঘাতে অ্যাগাভেডজি এবং আশেপাশের এলাকাগুলোতে প্রায় ৫১টি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ৩০০ জন মানুষ। স্থানীয় কর্মকর্তাদের মতে, ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে, যা এখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে চরমভাবে ব্যাহত করছে।
আফেলি বার্নিস আজো নামের ২৩ বছর বয়সী এক তরুণীর কথা ধরা যাক। তাঁর পরিবারের ১০টি ঘর ছিল, যা এখন সমুদ্রগর্ভে। তিনি জানান, ঢেউগুলো সাধারণত রাতে আসত, যা তাঁদের বাড়ির দেয়ালগুলোতে আঘাত হানত। কখনো এক সপ্তাহ, কখনো মাস বা বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলত। সম্প্রতি দেয়ালগুলো ভেঙে পড়ে এবং তাঁর দাদা-দাদির তৈরি করা ১০ কক্ষের বাড়িটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। এখন তাঁরা কাছের একটি পেট্রোল পাম্পের পাশে আশ্রয় নিয়েছেন, তবে যেকোনো সময় তাঁদের সেখান থেকেও চলে যেতে হতে পারে।
আজো বলেন, “আমি খুব দুঃখিত। আমার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। কাজে মন দিতে পারি না, কারণ সবসময় মনে হয় আমার বাবা-মায়ের কিছু একটা হবে।” তাঁর ৯ বছর বয়সী বোন স্কুলে যেতে চায় না। বাড়ির পাশের কবরস্থান থেকে ১০০ জনের বেশি মানুষের দেহ তুলে অন্য জায়গায় দাফন করতে হয়েছে।
ডেনিস ডস্টেই ডরভে নামের ২৮ বছর বয়সী এক যুবক জানান, প্রায় এক দশক আগে অ্যাগাভেডজিতে ভাঙন শুরু হয়। তাঁর বাবার তৈরি করা বাড়িটি ২০১৬ সালে ভেঙে যায়, যখন তিনি বাড়ির ভেতরে ছিলেন। ডরভে বলেন, “আমার থাকার ঘরটি এবং বাবার মৃত্যুর আগে যে ঘরে থাকতেন, সেটিও এখন নেই। ছোটবেলায় যেখানে আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম, সেখান থেকে সমুদ্রের দূরত্ব অনেক বেশি ছিল।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সরকার কাছাকাছি এলাকাগুলোতে সমুদ্র প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিলেও অ্যাগাভেডজির জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ডরভে বলেন, “আমরা সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছি, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি।”
মাকাফুই আটাযি নামের ৪৩ বছর বয়সী এক নারী জানান, ঢেউয়ের আঘাতে তাঁর বাড়ির দেয়ালগুলো এমনভাবে কাঁপত যে তাঁদের বাইরে ঘুমাতে হতো। তাঁর বাবার প্রথম বাড়িটি ২০১৯ সালে ভেঙে যায়। এরপর পরিবারের অনেক সদস্যকে বর্তমান বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়, যেটি ৮০ বছরের পুরনো। বর্তমানে সেখানে ১১ জন সদস্য রয়েছেন। আটাযি জানান, “আমাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই।”
আৎসু গডসলভ আফেলি নামের ৫২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি জানান, তাঁর বাড়ির ভাঙন ধীরে ধীরে শুরু হয়েছিল। এক মাস আগে পুরো বাড়িটি ভেঙে যায়। তিনি, তাঁর চার সন্তান এবং তাঁর ভাই এখন তাঁদের ধ্বংস হওয়া বাড়ির পেছনে একটি পেট্রোল পাম্পে ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছেন। আফেলি বলেন, “আমি কখনো ভাবিনি সমুদ্র আমাদের এত কাছে চলে আসবে। এখন আমি হতাশ, বিষণ্ণ এবং অসহায়।” তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই সমুদ্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হোক, যাতে আমরা আমাদের জমি ফিরে পেতে পারি। আমাদের নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য সাহায্য দরকার।”
এই ঘটনার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঘানার এই উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা যেভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, তা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি সতর্কবার্তা। আমাদেরও জরুরি ভিত্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে হবে, না হলে ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয় আরও বাড়বে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস