বিখ্যাত লেখক ও শিল্পী উইলিয়াম এস. বারোজের শিল্পকর্ম: একটি বিতর্কিত জীবন ও শিল্পকলার প্রতিচ্ছবি

গত শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী লেখক এবং শিল্পী ছিলেন উইলিয়াম এস. বারোজ। সম্প্রতি লন্ডনের অক্টোবর গ্যালারিতে তাঁর কিছু দুর্লভ শিল্পকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে তাঁর জীবন এবং কাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। বারোজের শিল্পকর্মগুলো কেবল নান্দনিকতার দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তাঁর বিতর্কিত জীবন এবং সমাজের প্রতি তাঁর গভীর উপলব্ধির প্রতিফলন ঘটায়।

বারোজের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য এবং বিতর্কিত। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘নেকেড লাঞ্চ’ (Naked Lunch)-এর মতো কাজগুলো সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে এবং প্রচলিত নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাঁর শিল্পকর্মেও এই বিদ্রোহের সুর স্পষ্ট। স্প্রে পেইন্ট, অ্যাক্রিলিক এবং বন্দুকের গুলির ব্যবহারের মতো অপ্রত্যাশিত উপাদান ব্যবহার করে তিনি শিল্পের চিরাচরিত ধারণা ভেঙেছেন।

বারোজের জীবন নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হলো ১৯৫১ সালে মেক্সিকো সিটিতে তাঁর সহযোগী জোয়ান ভলমারকে (Joan Vollmer) গুলি করে হত্যা করার ঘটনা। এই ঘটনা তাঁর ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেকে তাঁকে নারীবিদ্বেষী হিসেবেও অভিযুক্ত করেন। তবে তাঁর বন্ধু এবং শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ক্যাথলিন গ্রে (Kathelin Gray) বারোজকে রক্ষা করে বলেন, “এটি একটি দুর্ঘটনা ছিল। তিনি কখনোই জোয়ানকে হত্যা করতে চাননি।” গ্রে আরও জানান, বারোজ ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল একজন মানুষ এবং তাঁর শিল্পকর্মে সেই অনুভূতিগুলো ফুটে ওঠে।

প্রদর্শনীতে বারোজের ‘বার্ন ইউনিট’ (Burn Unit) শিরোনামের একটি চিত্রকর্ম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এতে মানুষের কষ্ট এবং যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় এবং মানুষের ধ্বংসাত্মক প্রবণতা নিয়েও তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মাদাগাস্কারের লেমুরদের ধ্বংসের চিত্র ফুটিয়ে তোলা একটি ছবি তাঁর পরিবেশ চেতনার প্রমাণ। তাঁর কাজে মানুষের লোভ এবং সমাজের ক্ষতিকর দিকগুলো সমালোচিত হয়েছে।

বারোজের শিল্পকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এতে সুযোগের (chance) ব্যবহার। তিনি তাঁর কাজে এই কৌশল ব্যবহার করে মানুষের অবচেতন মনের গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছেন এবং প্রচলিত ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বন্ধু ব্রিয়ন গাইসিনের (Brion Gysin) ‘কাট-আপ’ পদ্ধতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লেখায় এই কৌশল ব্যবহার করেন, যা পরবর্তীতে ডেভিড বোউই-এর মতো শিল্পীদেরও প্রভাবিত করেছে।

বারোজের শিল্পকর্ম বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তাঁর কাজের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমাজের অস্থিরতা সম্পর্কে গভীর ধারণা পাওয়া যায়। ক্যাথলিন গ্রে মনে করেন, বারোজ ছিলেন একজন দূরদর্শী শিল্পী, যিনি ভবিষ্যতের বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাঁর কাজ আমাদের আত্ম-উন্নয়ন এবং বাইরের জগতের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে সাহায্য করে।

উইলিয়াম এস. বারোজের শিল্পকর্ম আমাদের সমাজের নানা অসঙ্গতি, মানুষের ভেতরের দ্বন্দ্ব এবং প্রকৃতির প্রতি মানুষের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে উৎসাহিত করে। তাঁর কাজ বর্তমান বিশ্বের জন্য একটি সতর্কবার্তা এবং একইসঙ্গে উত্তরণের পথ দেখায়।

তথ্যসূত্র: The Guardian