ভবিষ্যতের ডিজাইন: পরিবেশ-বান্ধব পৃথিবীর স্বপ্নে নতুন দিগন্ত
বিশ্বজুড়ে পরিবেশ দূষণ আর জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট যখন তীব্র হচ্ছে, তখন ডিজাইন বা নকশার ধারণা নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে। শুধু সৌন্দর্য বা ব্যবহারের সুবিধার বাইরে, এখন ডিজাইন মানেই টেকসই সমাধান, যা পরিবেশের জন্য উপকারী এবং সমাজের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যের বিশ্ব ডিজাইন কংগ্রেস (World Design Congress – WDC) -এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘ডিজাইন ফর প্ল্যানেট’ বা ‘গ্রহের জন্য ডিজাইন’। এই সম্মেলনে ভবিষ্যতের ডিজাইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যেখানে উঠে এসেছে এমন কিছু নতুন প্রতিভার কথা, যারা ডিজাইনকে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন।
আসুন, এমনই কয়েকজন ব্যতিক্রমী ডিজাইনারের কাজ সম্পর্কে জানি, যারা ২০২৫ সাল এবং তার পরেও পৃথিবীর জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারেন।
আর্тур মামৌ-মানি (Arthur Mamou-Mani): স্থাপত্যের নতুন ভাষা
আর্тур মামৌ-মানি প্যারিসের বাসিন্দা। পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা এই তরুণ গণিত, বিজ্ঞান এবং শিল্পের প্রতি ভালোবাসার কারণে স্থাপত্যকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁর ডিজাইন স্টুডিও ‘মামৌ-মানি’ তৈরি করেছে অত্যাশ্চর্য সব স্থাপত্য।
ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি বালির প্যাভিলিয়ন, নেভাদার বার্নিং ম্যান ফেস্টিভেলের জন্য একটি অস্থায়ী মন্দির, ফ্রান্সের এয়ারশিপের পরীক্ষামূলক স্থান—এসবই মামৌ-মানির উদ্ভাবনী প্রতিভার প্রমাণ।
তাঁর ডিজাইনগুলোতে পরিবেশবান্ধব উপাদানের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং এবং পুনর্ব্যবহৃত উপকরণ ব্যবহার করে তিনি স্থাপত্যে নতুনত্ব যোগ করেছেন।
ফার্নান্দো লাপোস (Fernando Laposse): প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মেলবন্ধন
মেক্সিকোর ফার্নান্দো লাপোস আসবাবপত্র ডিজাইন করেন। তিনি স্থানীয় উপাদানের ব্যবহার এবং পরিবেশ সুরক্ষার ওপর জোর দেন।
মেক্সিকোতে জেনetically modified বা জিএম শস্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এরপর তিনি আদিবাসী কৃষকদের সাহায্য করার জন্য কাজ শুরু করেন।
স্থানীয় ‘মিক্সটেক’ সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে তিনি ‘টোনাউইক্সটলা’ অঞ্চলে ‘এগাভ’ এবং ভুট্টা চাষ করেন। এই গাছগুলোর তন্তু ও খোসা ব্যবহার করে তিনি তৈরি করেন আকর্ষণীয় আসবাবপত্র।
তাঁর ‘টোটোমোক্সটলে’ তৈরি আসবাবপত্র শুধু সুন্দরই নয়, মেক্সিকোর সংস্কৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবিও বহন করে।
কুশেদা মেনসা (Kusheda Mensah): পুনর্ব্যবহারের শিল্প
ব্রিটিশ-ঘানিয়ান ডিজাইনার কুশেদা মেনসা তৈরি করেন আরামদায়ক ও কার্যকরী আসবাবপত্র। তাঁর ডিজাইন করা চেয়ার এবং টেবিলগুলো পুনর্ব্যবহৃত ফোম ও টেক্সটাইল দিয়ে তৈরি।
তাঁর লক্ষ্য হলো, পুরনো জিনিসকে নতুন রূপ দেওয়া এবং পরিবেশের ক্ষতি না করে ডিজাইন তৈরি করা।
নাতাচাই অড্রে চিয়েজা (Natsai Audrey Chieza): ব্যাকটেরিয়ার জাদু
জিম্বাবুয়ের নাতাচাই অড্রে চিয়েজা-এর ডিজাইন ভাবনা অন্যদের থেকে একদম আলাদা। তিনি ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে কাপড় রাঙান।
তাঁর কোম্পানি ‘ফ্যাবার ফিউচারস’ (Faber Futures) -এর মাধ্যমে রাসায়নিকমুক্ত উপায়ে কাপড় তৈরির প্রক্রিয়া তৈরি করেছেন, যা জল দূষণ কমায়।
তাঁর ডিজাইন করা পোশাক ও ল্যাম্প তৈরিতে শৈবাল, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক ব্যবহার করা হয়। তাঁর মতে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হওয়া উচিত পারস্পরিক নির্ভরশীলতার, যেখানে সবাই একে অপরের থেকে উপকৃত হবে।
প্রিয়া আহলুওয়ালিয়া (Priya Ahluwalia): ফ্যাশনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
প্রিয়া আহলুওয়ালিয়া একজন ব্রিটিশ-নাইজেরিয়ান-ভারতীয় ফ্যাশন ডিজাইনার। তাঁর ডিজাইন করা পোশাকগুলোতে পুরনো কাপড় ব্যবহার করা হয়।
তিনি নাইজেরিয়া ও ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বাতিল পোশাকের পাহাড় দেখেছেন, যা তাঁকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। তাঁর ডিজাইনগুলো ফ্যাশন, সংস্কৃতি এবং পরিবেশ সুরক্ষার এক দারুণ মিশ্রণ।
সেবাস্টিয়ান কক্স (Sebastian Cox): কাঠের কারিগর
সেবাস্টিয়ান কক্স একজন আসবাব প্রস্তুতকারক, যিনি কাঠের কাজ করেন। তিনি পরিবেশ-বান্ধব ডিজাইন করেন এবং প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসেন। তাঁর তৈরি করা প্রতিটি পণ্যের কার্বন ফুটপ্রিন্ট (carbon footprint) হিসাব করা হয়।
এ ছাড়াও, এই তালিকায় আরও অনেক উজ্জ্বল নাম রয়েছে, যেমন – আর্টের অধ্যাপক ও স্থপতি জেইডেন আলি, ব্রাজিলের ‘অ্যাসিম্পলি স্টুডিও’, যুক্তরাষ্ট্রের মাইকেল বেনেট, সেনেগালের এনজিঙ্গা বিগুয়েং-এমবুপ, ভারতের শাজেয় বুশান, ফ্যাশন ডিজাইনার ফোবি ইংলিশ, তাইওয়ানের আর্থার হুয়াং, শেলওয়ার্কসের ইনসিয়া জাফরজি, গ্রাফিক ডিজাইনার কিয়েরন লুইস, ডিজাইনার ইমানুয়েল লয়াল, ডেনমার্কের সারা মার্টিনসেন, চার্লোট ম্যাককার্ডি, ডাচ ডিজাইনার মারজান ভ্যান আউবেল এবং শিল্পী সোফিয়া ওয়াং।
ডিজাইনের এই নতুন ধারণাগুলো আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের চারপাশে যেসব সমস্যা রয়েছে, যেমন—প্রকৃতির ক্ষতি, দূষণ, সম্পদের অভাব, সেগুলোর সমাধানে ডিজাইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও, টেকসই ডিজাইন ভবিষ্যৎ উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার, পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি, এবং ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে ডিজাইন তৈরি করে আমরা একটি উন্নত ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে পারি।
তথ্যসূত্র: The Guardian