আলঝেইমার’স রোগের উপসর্গ দেরিতে শুরু করার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে নতুন গবেষণা।
বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়তে থাকা আলঝেইমার’স (Alzheimer’s) রোগের চিকিৎসা নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় এমন একটি পরীক্ষামূলক চিকিৎসা পদ্ধতির ইঙ্গিত মিলেছে, যা এই রোগের উপসর্গগুলি দেখা দিতে বিলম্বিত করতে পারে।
বিশেষ করে, যাদের এই রোগ হওয়ার জিনগত সম্ভাবনা রয়েছে এবং সাধারণত যাদের জীবনের চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়, তাদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি। গবেষণায় এমন কিছু পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে আলঝেইমার’স রোগের বিরল কিছু জিনগত রূপান্তর (mutation) রয়েছে।
এই পরিবর্তনের কারণে পরিবারের সদস্যরা একই বয়সে এই রোগে আক্রান্ত হন। গবেষকরা বলছেন, এই তথ্য চিকিৎসার কার্যকারিতা যাচাই করতে সহায়ক হবে।
গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদে ওষুধ গ্রহণকারী ২২ জন রোগীর একটি উপদলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। গড়ে আট বছর ধরে তাদের শরীরে অ্যামাইলয়েড (amyloid) নামক একটি প্রোটিন অপসারণকারী ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
অ্যামাইলয়েড মস্তিষ্কে জমা হয়ে আলঝেইমার’স রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। গবেষকরা দেখেছেন, এই দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার ফলে রোগীদের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেওয়ার ঝুঁকি প্রায় অর্ধেক কমে গেছে।
গবেষণার এই ফলাফল ‘ল্যানসেট নিউরোলজি’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
যদিও গবেষণার আকার ছোট, তবুও এর গুরুত্ব অনেক। নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির স্নায়ুবিজ্ঞানী ডেভিড গেট (David Gate) এই গবেষণার সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থেকেও এর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, “এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে, এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের আগের একটি পরীক্ষামূলক ওষুধ পরিবর্তন করে ‘লেকিম্বি’ (Leqembi) দেওয়া হচ্ছে। ‘লেকিম্বি’ হলো একটি ইনজেকশনযোগ্য ওষুধ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত হয়েছে।
গবেষকরা আগামী পাঁচ বছরে এই চিকিৎসার প্রভাব আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চান। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ড. র্যান্ডাল ব্যাটম্যান (Dr. Randall Bateman) বলেন, “আমরা দেখতে চাই, এই চিকিৎসা কতটা শক্তিশালী সুরক্ষা দিতে পারে।
আমরা জানতে আগ্রহী, যদি আমরা চিকিৎসা চালিয়ে যাই, তবে তারা কি আদৌ আলঝেইমার’স রোগের উপসর্গ অনুভব করবে?”
তবে, এই গবেষণা বর্তমানে কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে সমস্যা হচ্ছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (National Institutes of Health – NIH) থেকে অনুদান পেতে বিলম্ব হচ্ছে, যার কারণ প্রশাসনিক জটিলতা এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রভাব।
এমনকি, NIH-এর নতুন পরিচালক মনোনয়ন নিয়েও অ্যামাইলয়েড-বিষয়ক গবেষণা অব্যাহত রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
আলঝেইমার’স রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে। নিউইয়র্কের বাসিন্দা, জ্যাক হেনরিখস (Jake Heinrichs) তেমনই একজন।
তিনি আলঝেইমার’স রোগের জিন বহন করেন। তাঁর বাবা ও ভাইয়েরও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে একই বয়সে মৃত্যু হয়েছিল।
বর্তমানে ৫০ বছর বয়সী হেনরিখস এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন এবং দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ গ্রহণ করছেন। তিনি এখনো রোগমুক্ত জীবন যাপন করছেন।
তাঁর স্ত্রী র্যাচেল চাভকিন (Rachel Chavkin) বলেন, “এই গবেষণা আমাদের জন্য জীবন বাঁচানোর মতো।
গবেষকরা মনে করেন, আলঝেইমার’স রোগের কারণ সম্পূর্ণরূপে এখনো জানা না গেলেও, মস্তিষ্কে অ্যামাইলয়েডের জমাট বাঁধা একটি প্রধান কারণ।
অ্যামাইলয়েডের কারণে ‘টাউ’ (tau) নামক একটি প্রোটিন সক্রিয় হয়, যা নিউরনের (neuron) ক্ষতি করে এবং স্মৃতিভ্রংশ ঘটায়।
বর্তমানে টাউ-এর বিরুদ্ধে কাজ করে এমন ওষুধ নিয়েও গবেষণা চলছে। এছাড়া, মস্তিষ্কের প্রদাহ, রোগ প্রতিরোধক কোষ এবং কিছু ভাইরাসের ভূমিকা নিয়েও গবেষণা চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ আলঝেইমার’স রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশেও এই রোগের প্রকোপ বাড়ছে।
তাই, এই ধরনের গবেষণা একদিকে যেমন আক্রান্তদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে, তেমনি রোগের কারণ অনুসন্ধান ও কার্যকর চিকিৎসার পথ খুলে দিতে পারে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (Associated Press)