বার্সেলোনায় পর্যটকদের ভিড় : শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার লড়াই।
পর্যটকদের অতিরিক্ত আনাগোনায় জর্জরিত স্পেনের বার্সেলোনা শহর। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা পর্যটকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, কখনো শ্লোগান দিচ্ছে, আবার কখনও বা ছোটখাটো প্রতিরোধের মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছে। সম্প্রতি, পর্যটকদের প্রতি তাদের অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে খেলনা পিস্তল দিয়ে জল ছোড়ার ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু এই ঘটনার পেছনে রয়েছে গভীর এক সংকট। একদিকে, পর্যটন বার্সেলোনার অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা শহরের ১৪ শতাংশ আয় যোগান দেয় এবং প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করে। অন্যদিকে, পর্যটকদের অবিরাম আনাগোনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। তাদের বাসস্থান সংকট, উচ্চ মূল্যের বাজারে টিকে থাকার সংগ্রাম, এবং শহরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
১৯৯২ সালের অলিম্পিক গেমস বার্সেলোনার জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল। অলিম্পিকের পর শহরটির আধুনিকীকরণ করা হয়, সমুদ্রের কাছাকাছি নতুন করে রাস্তাঘাট ও পর্যটন কেন্দ্র তৈরি হয়। এর ফলস্বরূপ, পর্যটকদের আগমন বাড়তে থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৪ সালে যেখানে প্রায় ৪৫ লক্ষ পর্যটক বার্সেলোনায় রাত কাটিয়েছিল, ২০১৯ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ১ কোটি ৬০ লক্ষ। কোভিড-১৯ অতিমারীর আগে পর্যটকদের এই বিপুল আগমন সেখানকার জীবনযাত্রায় এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
এই মুহূর্তে, বার্সেলোনার কর্তৃপক্ষ পর্যটনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। পর্যটকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যা আবাসিক এলাকার আবাসন সংকট সমাধানে কাজে লাগবে। পর্যটকদের জন্য স্বল্পমেয়াদী ভাড়ার অ্যাপার্টমেন্টের সংখ্যা কমানোরও চিন্তা-ভাবনা চলছে। শহরের মেয়র জানিয়েছেন, এই পদক্ষেপগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।
তবে, পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। তাদের মতে, অতিরিক্ত কর আরোপ করা হলে তা পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করবে এবং ব্যবসার ক্ষতি হবে।
পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণীয় স্থানগুলোতেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। লা রামবলা এবং সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার মতো জনপ্রিয় স্থানগুলোতে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেন্সর বসানো হয়েছে। টিকিট কাটার ক্ষেত্রেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। এখন অনলাইনে অগ্রিম টিকিট কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে দর্শনার্থীদের চাপ কমানো যায়।
বার্সেলোনার এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে। আমাদের দেশেও কক্সবাজার, সিলেট এবং সুন্দরবনের মতো জনপ্রিয় স্থানগুলোতে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। অতিরিক্ত পর্যটনের কারণে সেখানকার পরিবেশ, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বার্সেলোনার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, আমাদের এখনই পর্যটনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান তৈরি করার পাশাপাশি, স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিবেশ রক্ষার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে এবং পর্যটন শিল্পের সুষম বিকাশে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।
তথ্যসূত্র: সিএনএন