ফিলিস্তিনের ‘ভূমি দিবস’-এর আসল অর্থ, গাজার এক বাসিন্দার চোখে।
প্রতি বছর ৩০শে মার্চ তারিখে, ফিলিস্তিনে পালিত হয় ‘ভূমি দিবস’। এই দিনটি সেখানকার মানুষের কাছে তাদের জমির অধিকারের সংগ্রামকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ছোটবেলায়, ফিলিস্তিনের শিশুরা স্কুলে সমবেত হয়ে তাদের ভূমি ও সংস্কৃতির প্রতি উৎসর্গীকৃত গান গাইত। মেয়ে শিশুরা পরত ঐতিহ্যবাহী এমব্রয়ডারি করা পোশাক, আর ছেলেরা সাদা শার্ট ও কেফিয়েহ (মাথায় দেওয়ার স্কার্ফ) পরিধান করত। ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে তারা ভূমি নিয়ে হওয়া সংগ্রামের কথা স্মরণ করত।
গাজা শহরের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত শুজাইয়া নামক একটি এলাকার বাসিন্দা, যিনি তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই ‘ভূমি দিবস’-এর আসল তাৎপর্য উপলব্ধি করেছেন। তিনি জানান, বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর, নিজের ভূমি হারানোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েই তিনি এই দিবসের গভীরতা অনুভব করতে পেরেছেন।
শুজাইয়া, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা একটি জনপদ। একসময় এটি ছিল গাজার অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, যা তার শক্তিশালী সম্প্রদায় এবং প্রতিরোধের ইতিহাসের জন্য পরিচিত।
লেখক জানান, তার পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে শুজাইয়াতেই বসবাস করে আসছেন। তাদের বাড়িগুলো ছিল যেন এক একটি ভালোবাসার আশ্রয়স্থল, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই স্থানে নির্মিত হয়েছে। তাদের জমির গভীরতা বোঝাতে ‘মুশতাহা স্ট্রিট’ নামক একটি রাস্তার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
শুধু বসতবাড়িই নয়, শুজাইয়াতে ছিল তাদের চাষের জমি, যেখানে তারা ফলিয়েছেন নানা ধরনের ফসল। লেখকের শৈশব কেটেছে তার দাদার জলপাই বাগানে, যা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। জলপাই গাছগুলো তাদের শিখিয়েছিল কীভাবে ভূমিকে ভালোবাসতে হয়, আর তাদের মতোই অবিচল থাকতে হয়।
ছোটবেলায় লেখক কখনোই তার জন্মভূমি, তার এলাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি। তিনি চেয়েছিলেন, তার পূর্বপুরুষদের মতোই এই ভূমিতে বসবাস করতে, তাদের জমি-জমা দেখাশোনা করতে এবং জলপাই গাছগুলোর যত্ন নিতে।
কিন্তু ২০১৪ সালে ইসরায়েলি হামলায় প্রথমবার তাদের শুজাইয়া ছাড়তে হয়। এরপর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২৪ সালের জুনেও তারা একই অভিজ্ঞতার শিকার হন। ধ্বংসের বিভীষিকা তাদের তাড়া করে ফিরেছে বারবার। তাদের বাড়িঘর, মাঠ-ঘাট—সবকিছুই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
ইসরায়েলি ট্যাঙ্কগুলো যখন শুজাইয়াতে প্রবেশ করে, তখন তারা বাজারের দোকান, পুরনো রেস্টুরেন্ট, বিদ্যুতের খুঁটি এবং পানির পাম্পগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। তাদের আক্রমণে এলাকার অনেক কিছুই এখন আর আগের মতো নেই।
লেখকের পরিবারের বাড়িও বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার দাদার জলপাই বাগানও রক্ষা পায়নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফলন দিয়ে আসা গাছগুলো উপড়ে ফেলা হয়, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
দাদার পক্ষে এই ক্ষতি সহ্য করা সম্ভব হয়নি। তিনি এই শোক সইতে না পেরে তিন মাসের মধ্যেই মারা যান।
বর্তমানে, শুজাইয়ার মানুষ আবারও বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। ইসরায়েলি বাহিনীর হুমকির মুখে এলাকার পূর্বাংশের বাসিন্দারা ঘর ছাড়তে শুরু করেছে। অনিশ্চয়তা আর ভয়ের মধ্যে তারা দিন কাটাচ্ছে, কিন্তু এখনও একটি যুদ্ধবিরতির অপেক্ষায় আছে।
এ বছর ‘ভূমি দিবস’-এর তাৎপর্য ভিন্ন। চলমান যুদ্ধের মধ্যেও তারা তাদের ভূমিতে টিকে আছে, তাদের শিকড় আঁকড়ে ধরে আছে। তারা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া জমি ছাড়বে না।
এই দিনে, লেখক ড. রিফাত আল-আরের একটি কবিতার কথা স্মরণ করেন— ‘ওহে পৃথিবী, আলিঙ্গন করো আমাকে, জড়িয়ে ধরো শক্ত করে, নয়তো গ্রাস করো, যাতে আর কোনো কষ্ট না থাকে। আমি তোমায় ভালোবাসি, তাই আমায় নাও। আমাকে ধনী করো, কিংবা করো মাটি। শান্তির দিন ফুরিয়েছে, বন্দুকের শব্দই এখন মানবতার ভাষা। আমার খাবার নেই, আছে শুধু কাঁটা, খেলা নেই, আছে দীর্ঘশ্বাস। কারণ একজন সৈনিককে উড়তে হয়। ওহে পৃথিবী, যদি জীবনে কষ্ট পেতে হয়, তবে আমার মাটি যেন জন্ম দেয় তোমাতে। ওহে পৃথিবী’।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা