গাজায় ঈদ: শোকের আগুনে পুড়ে যাওয়া এক বোনের স্মৃতি।
ঈদ-উল-ফিতর মানে আনন্দ আর উৎসবের দিন। নতুন পোশাকে শিশুদের দৌড়াদৌড়ি, বড়দের দেওয়া ঈদ সালামি (ঈদ-এর উপহার হিসেবে টাকা) পাওয়ার উল্লাস, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ঘোরাঘুরি—এসবই তো ঈদের চিরাচরিত চিত্র।
ঘরগুলো ভরে ওঠে সেমাইয়ের ঘ্রাণে, আর মিষ্টিমুখ করার জন্য মুখোরোচক সব খাবার তো থাকেই। কিন্তু গাজায় এই ঈদ যেন এক গভীর শোকের ছায়া।
ধ্বংসস্তূপের ধুলোয় বাতাস ভারী হয়ে আছে, আর অবিরাম বোমা হামলায় আকাশ সবসময় প্রকম্পিত।
বৈরী পরিস্থিতির কারণে সেখানে আনন্দের বদলে পরিবারগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝে প্রিয়জনদের হারিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছে।
ক্ষুধার জ্বালায় অনেকে জীবন বাঁচানোর লড়াই করছে, আর প্রতিক্ষণ যেন আতঙ্কের মধ্যে কাটছে—কখন জানি আবার বোমা এসে সব শেষ করে দেয়।
ঘুমহীন রাতগুলো দুঃস্বপ্নের মতো, যেখানে স্মৃতিগুলো কিছুতেই মন থেকে মুছে যেতে চায় না।
আমার জীবনে এবারই প্রথম ঈদ, যখন আমার আদরের ছোট বোন রাহাফ নেই।
রাহাফ ছিল আমার একমাত্র বোন, আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।
গণহত্যার সময় আমরা দু’জন দু’জনের হাত ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছি, একে অপরের মধ্যে খুঁজেছি শান্তি।
আমরা তোরোটা ঈদ একসঙ্গে কাটিয়েছি, আর রাহাফ ছিল প্রতিটি ঈদের আনন্দ।
ছোটবেলা থেকেই সে সবার আগে ঘুম থেকে উঠত, সারা বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াত, আর ঈদ এসেছে বলে চিৎকার করত।
নতুন জামা পরে, আমার কাছে চুল বাঁধার বায়না ধরত, এরপর আমরা দাদিদের বাড়ি যেতাম।
সেখানে পরিবারের সবাই মিলে চা খেতাম, আর মায়েদের হাতে বানানো নানা পদের মিষ্টিমুখ করতাম।
কিন্তু এবার? এবার কোনো প্রস্তুতি নেই, যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই, আর রাহাফও নেই।
আমি কখনোই ভাবিনি যে, ওকে হারাবো।
ওর এই চলে যাওয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
আমরা দু’জন মিলে স্বপ্ন দেখতাম, একসঙ্গে পথ চলব, একসঙ্গে জীবনের প্রতিটি মাইলফলক উদযাপন করব।
রাহাফের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন ছিল, চেয়েছিলাম ওর ছবিগুলো সবার কাছে পরিচিত হোক।
আমি চেয়েছিলাম, আমার প্রথম বই বের হলে আমরা একসঙ্গে উদযাপন করব।
কিন্তু সেই রাহাফকে গত ২৮শে ডিসেম্বর কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
আমরা যখন গভীর ঘুমে, ভোর ৪টায় আমার চাচার বাড়ির ওপর বোমা পড়ে।
সেই বিস্ফোরণে আমাদের ঘরও ধ্বংস হয়ে যায়।
রাহাফ ঘুমিয়ে ছিল আমার চাচার বাড়ির কাছাকাছি একটা ঘরে, আর সেই ঘরটিই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
আসলে, আগে আমিই ওই ঘরে ঘুমাতাম।
ঘটনার চার দিন আগেও আমরা ঘর বদল করেছিলাম।
এরপর থেকে শোক প্রকাশ করারও কোনো সুযোগ পাইনি।
বোমার শব্দের মধ্যে কি শোক প্রকাশ করা যায়?
কিভাবে একজন মানুষ সুস্থ হবে, যখন প্রতি মুহূর্তে প্রিয়জন হারানোর ভয়?
কীভাবে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা যায়, যখন সেই ভবিষ্যৎকেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে?
আমার এই গভীর শোকের মাঝেও আমি দেখেছি, এমন কিছু মানুষ আছে যারা রাহাফের মৃত্যুটা আমার চেয়েও হয়তো বেশি অনুভব করতে পারছে।
আমরা যখন সীমাহীন কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি, তখন শিশুরা তাদের নিজস্ব কষ্টগুলো একা বয়ে বেড়াচ্ছে।
তাদেরও তো অনেক স্বপ্ন ছিল, যা কেড়ে নিয়েছে এই ধ্বংসযজ্ঞ, কেড়ে নিয়েছে প্রিয়জনদের সান্নিধ্য।
আমার সাত বছর বয়সী চাচাতো বোন কামার সম্প্রতি আমার কাছে এসে জানতে চেয়েছিল।
একদিন বিকেলে, যখন আমি আরেক চাচার বাড়িতে বসেছিলাম, যিনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, কামার আমার পাশে এসে বসল।
তার ছোট্ট হাতটি আমার বাহুতে রাখল।
আমি বুঝতে পারছিলাম, সে কিছু একটা বলতে চাইছে।
কামার কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল, “শাহদ, তুমি কেন নিজের বাড়িতে নেই? বাড়িটা কোথায়?”
ছোট্ট একটি মেয়ের এমন প্রশ্নে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো, মনে হলো হাজারো স্মৃতি যেন আমাকে ঘিরে ধরছে, যা আমি তার নিষ্পাপ চোখের সামনে ব্যাখ্যা করতে পারছি না।
আমি বললাম, “আমাদের বাড়িটা তো ধ্বংস হয়ে গেছে, বোমা হামলায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।
দেয়াল নেই, স্মৃতিগুলোও নেই, আর রাহাফও নেই।”
কামার কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আর রাহাফ, সে কোথায়?”
আমি জানি, কামারকে হয়তো বলা হয়েছে যে রাহাফ নেই, তাই তার এই প্রশ্নটা যেন একটি শীতল বাতাসের মতো আমার শরীরে লাগল।
রাহাফকে হারানোর কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, বিশেষ করে কামারের মতো একটি শিশুর জন্য, যে রাহাফের হাসি আর ভালোবাসার সঙ্গে পরিচিত ছিল।
আমি চোখ বন্ধ করে বললাম, “রাহাফ এখন স্বর্গে আছে।
বোমা হামলায় তাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, আমরা তাকে আর ফিরিয়ে আনতে পারব না।”
কামারের চোখে তখনো সেই দ্বিধা, সেই নিষ্পাপ দৃষ্টি।
সে জানতে চাইল, “কেন তাকে যেতে হলো? কেন তারা তাকে নিয়ে গেল?”
আমি তাকে কাছে টেনে নিলাম, আমার হাত কাঁপছিল।
“আমি জানি না কামার, আমি যদি পারতাম, তাহলে বুঝিয়ে বলতে পারতাম।”
কামার ফিসফিস করে বলল, “আমি তাকে আবার দেখতে চাই, আমি তাকে খুব মিস করি।”
আমার চোখ জলে ভরে গেল, হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল।
“আমিও তাকে খুব মিস করি, প্রতিদিন করি।
কিন্তু সে সবসময় আমাদের সঙ্গে আছে, আমাদের হৃদয়ে।”
আমি ভাবছিলাম, কবে কামার বুঝবে যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা—যা শুধু ভূমিকে নয়, মানুষকেও ধ্বংস করে দেয়।
কতদিন পর সে বুঝবে, যখন আমরা এগিয়ে যেতে চাই, তখনও হারানোর বেদনা একটা ছায়ার মতো আমাদের সঙ্গে লেগে থাকে।
আমি চাই না, সে এসব বুঝুক।
সে এখনো অনেক ছোট, এই কঠিন বাস্তবতার ভার নেওয়ার মতো বয়স হয়নি তার।
তার এই কষ্ট পাওয়ার কথা নয়।
আমি যদি পারতাম, তাহলে গাজার শিশুদের আমার হৃদয়ে লুকিয়ে রাখতাম, তাদের সন্ত্রাস, ভয় আর শোক থেকে বাঁচাতাম।
পৃথিবী চায় আমরা শক্তিশালী হই, ‘সুমুদ’ (দৃঢ়তা) দেখাই।
কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতা আর শোকের মধ্যে বেঁচে থাকতে থাকতে অন্য কিছু করার মতো মানসিক শক্তি থাকে না।
ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার কোনো সুযোগ নেই, এমন একটি গণহত্যার মধ্যে টিকে থাকা এক বিশাল বোঝা।
বেঁচে থাকার জন্য যখন সমস্ত শক্তি প্রয়োজন, তখন শোক করারও কোনো জায়গা থাকে না।
কিন্তু আমরা যাদের হারিয়েছি, তাদের ভালোবাসাকে ধরে রাখি, তাদের স্মৃতি, তাদের কথা আর আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে তাদের বাঁচিয়ে রাখি।
আশা, তা যত দুর্বলই হোক না কেন, প্রতিরোধের একটি রূপ।
এটি ধ্বংসস্তূপের মাঝে আলো খুঁজে ফেরা, শূন্যতার মাঝে অর্থ খোঁজা, আর নিছক বেঁচে থাকার চেয়েও বেশি কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা এখনো এখানে আছি।
আর এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা।