ঘরের ধুলো, যা হয়তো আমাদের কাছে খুব সাধারণ একটা বিষয়, আসলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির এক বিশাল ভাণ্ডার। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ধুলোর কণাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরের ধুলোয় শুধু মৃত চামড়ার কোষ, চুল, পোষা প্রাণীর লোম, কাপড়ের সূক্ষ্ম তন্তু, ধুলো-মাকড়সা, ছত্রাকের স্পোর (বীজ) বা বাইরের মাটি-কণা—এগুলোই থাকে না। এর সাথে যোগ হয় আমাদের অজান্তে মিশে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঘরের ধুলোয় প্রায় ৪৫টির মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – ফ্যাথালেটস, ফেনলস এবং ফ্লেম রিটার্ডেন্টস। এছাড়াও কীটনাশক, পার- এবং পলিফ্লুরোঅ্যালকাইল পদার্থ (পিএফএএস), যা ‘চিরকালের রাসায়নিক’ নামে পরিচিত, সীসা এবং অন্যান্য উদ্বায়ী জৈব যৌগও এতে বিদ্যমান।
পিএফএএস (PFAS) খুবই উদ্বেগের কারণ, কারণ এটি সহজে পরিবেশে মিশে যায় এবং সহজে ভাঙে না। এটি দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের শরীরে থাকতে পারে এবং স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঘরের ধুলোর মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরে পিএফএএসের প্রবেশ তাদের মোট এক্সপোজারের প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে, যারা মেঝেতে বেশি সময় কাটায় এবং হাত মুখে দেয়, তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি আরও বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘরের ধুলোয় বিদ্যমান আট ধরনের পিএফএএসের সংস্পর্শে আসা শিশুদের মধ্যে লিউকোমিয়া (রক্তের ক্যান্সার) হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি।
তাহলে, এই ধুলোর কণাগুলো আমাদের শরীরে কিভাবে ক্ষতি করে?
ঘরের ধুলোর মধ্যে থাকা অনেক রাসায়নিকই এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টিং কেমিক্যালস (EDCs) গোত্রের। এই রাসায়নিকগুলো শরীরের হরমোনগুলোর স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটায় বা তাদের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। এর ফলে শরীরে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
শ্বাসকষ্ট, এলার্জি বা অ্যাজমা বেড়ে যাওয়া এর প্রাথমিক লক্ষণ। দীর্ঘমেয়াদে, ইডিসিগুলোর কারণে বন্ধ্যাত্ব, কিছু ধরনের ক্যান্সার (যেমন স্তন ক্যান্সার), স্থূলতা, টাইপ ২ ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা, লিভার ও কিডনির রোগ, এবং স্নায়ু ও বিকাশে সমস্যা হতে পারে।
শিশুরা, বিশেষ করে সাত বছর বা তার কম বয়সী শিশুরা, ধুলোর ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হয় বেশি। কারণ, তাদের শরীর ও মস্তিষ্ক এখনো গঠিত হচ্ছে। গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রেও এই ঝুঁকি থাকে, কারণ ফ্যাথালেটের মতো কিছু রাসায়নিক গর্ভস্থ শিশুর প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে।
এছাড়াও, বয়স্ক ব্যক্তি এবং আগে থেকেই স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন হৃদরোগ বা ফুসফুসের রোগ) রয়েছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকির সম্ভাবনা বেশি।
ঘরের ধুলো থেকে বাঁচতে আমাদের কী করা উচিত?
ঘরের ধুলো কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, নিয়মিত ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করা। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহারের সময়, ঘরের কোণা, সোফার নিচে এবং জানালায় জমে থাকা ধুলো পরিষ্কার করতে ভুলবেন না। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার-এর ‘হাই এফিসিয়েন্সি পার্টিকুলেট এয়ার’ (HEPA) ফিল্টার ধুলোর কণা শুষে নিতে সাহায্য করে।
এছাড়াও, ভালো মানের ফার্নেস ফিল্টার ব্যবহার করা যেতে পারে এবং এটি এক থেকে তিন মাস পর পর পরিবর্তন করা উচিত।
ঘরের বাতাস পরিষ্কার করার জন্য HEPA ফিল্টারযুক্ত এয়ার ক্লিনার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, ওজোন জেনারেটর বা আয়নাইজার আছে এমন এয়ার ক্লিনার ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এগুলো থেকে নির্গত হওয়া ক্ষতিকর রাসায়নিক ধুলোর সাথে মিশে যেতে পারে।
ঘরের পরিচ্ছন্নতার জন্য ব্যবহৃত কিছু পণ্য, যেমন কার্পেট শ্যাম্পু, সাধারণ ক্লিনার, জানালা পরিষ্কার করার স্প্রে—এগুলোতেও ইডিসি বা অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকতে পারে। তাই, এইসব ক্লিনিং প্রোডাক্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত।
ধুলো পরিষ্কার করার জন্য ভেজা কাপড় ব্যবহার করা ভালো। ভেজা কাপড় ধুলোকে ভালোভাবে শোষণ করতে পারে। শুকনো ঝাড়ু ব্যবহার করলে ধুলো বাতাসে আরও বেশি ছড়ায়, তাই ভেজা কাপড় বা মপ ব্যবহার করা ভালো।
শিশুদের খেলনা এবং তাদের হাত নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বিশেষ করে খাওয়ার আগে তাদের হাত ধোয়ার অভ্যাস করানো উচিত।
ঘরের ধুলো সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা হয়তো সম্ভব নয়, তবে কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে এর ক্ষতিকর প্রভাব কমানো যেতে পারে। নিয়মিত ঘর পরিষ্কার রাখা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের এবং আমাদের পরিবারের সদস্যদের সুস্থ রাখতে পারি।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক