হাইতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফ্রান্সের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চাইছে দেশটি। দেশটির জনগণের দাবি, ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হওয়া হাইতিকে কয়েক বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। হাইতির বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে এই অর্থ সাহায্য করতে পারে বলে মনে করছেন দেশটির নাগরিকরা।
১৮০৪ সালে হাইতি স্বাধীনতা লাভ করে। এর কয়েক বছর পর, ১৮২৫ সালে, ফ্রান্স হাইতির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিশাল অঙ্কের অর্থ দাবি করে। ফরাসি উপনিবেশ স্থাপনকারীরা, যারা হাইতিতে দাস ব্যবসা করত, তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য এই অর্থ আদায় করা হয়েছিল।
হাইতির ন্যাশনাল কমিটি অন রেস্টিটিউশন অ্যান্ড রেপ্যারেশনস (এইচএনসিআরআর)-এর প্রধান ফ্রিটজ দেশোমসের মতে, সেই সময়ের ১৫ কোটি ফ্রাঙ্ক-এর (পরে যা ৯০ মিলিয়নে নেমে আসে) বর্তমান মূল্য প্রায় ৩৮ বিলিয়ন থেকে ১৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে হতে পারে।
ঐতিহাসিক এই ক্ষতিপূরণের দাবি হাইতির জনগণের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই অর্থ আদায়ের ফলে হাইতি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এক সময় ক্যারিবীয় অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি উপনিবেশ ছিল হাইতি। এই দেশটিতে হাজার হাজার আফ্রিকানকে ধরে এনে দাস হিসেবে বিক্রি করা হতো।
দাসত্বের বিরুদ্ধে হাইতির মানুষের লড়াই ছিল অত্যন্ত কঠিন। নিজেদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে তারা স্বাধীনতা অর্জন করে।
এইচএনসিআরআর-এর সদস্য জঁ মোজার্ট ফেরন বলেন, “এই ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ের ফলে হাইতি এমন একটি অর্থনৈতিক চক্রে আটকে যায়, যা থেকে দেশটি আজও মুক্তি পায়নি। তরুণ দেশটির উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ক্ষতিপূরণের এই অর্থ আদায়ের কারণে হাইতিতে গভীর দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও হাইতিকে দুর্বল চোখে দেখা হয়। কোলেক্টিফ আইসিয়েন আফওদেসন্দন-এর মুখপাত্র মনিক ক্লেসকা বলেন, “এই বিশাল ঋণের বোঝা দেশটির উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিকভাবে এটি প্রায় একটি নব্য-উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল, যা ফ্রান্সের কাছে অর্থনৈতিক, প্রতীকী ও রাজনৈতিকভাবে আবদ্ধ ছিল।
হাইতির নাগরিকরা ফ্রান্স সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ এবং দাসত্ব ও উপনিবেশের কারণে হওয়া ক্ষতির প্রতিকার চাইছে। ক্যারিবীয় সম্প্রদায় (ক্যারিবিয়ান কমিউনিটি বা কারিকম) ক্ষতিপূরণের জন্য একটি ১০-দফা পরিকল্পনা তৈরি করেছে এবং এইচএনসিআরআর-এর সঙ্গে কাজ করছে। জাতিসংঘে আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মানুষের জন্য আয়োজিত এক ফোরামে কারিকমের সেক্রেটারি-জেনারেল ড. কার্লা বার্নেট হাইতির ক্ষতিপূরণের দাবির প্রতি সমর্থন জানান।
তিনি বলেন, “ঐতিহাসিক এই অবিচারের নেতিবাচক অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট, যা বর্তমান হাইতির পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত। এই বার্ষিকী হাইতির পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর ধারণা তৈরি এবং দেশটিতে চলমান নিরাপত্তা, মানবিক ও সুশাসনের সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়ার একটি সুযোগ।
এইচএনসিআরআর মনে করে, ক্ষতিপূরণ কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে ফ্রান্স ও হাইতির মধ্যে একটি চুক্তি হতে পারে। তবে, ক্ষতিপূরণের অর্থ ব্যবহারের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে হাইতির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
২০২১ সালে হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়েজকে হত্যার পর দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এরপর গ্যাং সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন সত্ত্বেও, দেশটিতে স্থিতিশীল গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা যায়নি।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান