যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট অফ কলম্বিয়ার (ডিসি) শীর্ষ কৌঁসুলি হিসেবে ট্রাম্পের মনোনীত এড মার্টিন সিনেটে জমা দেওয়া তথ্যে গণমাধ্যমে তার উপস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ দেননি। সম্প্রতি সিএনএন-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, মার্টিন রক্ষণশীল বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রায় দুই শতাধিক বার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যা তিনি সিনেটে জানাননি।
এড মার্টিন দীর্ঘদিন ধরে একজন রক্ষণশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পরিচিত। তিনি এর আগে মিসৌরি রিপাবলিকান পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। গত জানুয়ারি মাস থেকে তিনি ডিস্ট্রিক্ট অফ কলম্বিয়ার অ্যাটর্নি হিসেবে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এই সময়ে তার কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণে তিনি আলোচনায় এসেছেন, যার মধ্যে ফেডারেল প্রসিকিউটরদের কার্যালয়কে ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আইনজীবী’ হিসেবে উল্লেখ করা অন্যতম।
এছাড়া, ৬ জানুয়ারি ২০২১-এ ক্যাপিটলে হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কাজ করা সিনিয়র আইনজীবীদের তিনি পদাবনতি করেছিলেন।
মার্চ মাসে ট্রাম্প তাকে স্থায়ীভাবে এই পদে নিয়োগের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেন। এরপর মার্টিন সিনেটে তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জমা দেন, যেখানে তার গণমাধ্যমে উপস্থিতির হিসাবও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু সিএনএন-এর কে-ফাইল বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায়, মার্টিনের জমা দেওয়া ২৭ পৃষ্ঠার নথিতে তার গণমাধ্যমে উপস্থিতির সম্পূর্ণ চিত্র ফুটে ওঠেনি।
শুধু গত দুই বছরেই তিনি অন্তত ২৪০টি পডকাস্ট, রেডিও এবং টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, যার কোনো উল্লেখ ছিল না।
পরে, মার্টিন অবশ্য দু’বার তার তথ্য সংশোধন করেন, যার মধ্যে ১৫ এপ্রিল জমা দেওয়া ১২ পৃষ্ঠার একটি অতিরিক্ত ফর্মও ছিল, যেখানে আরও অনেক গণমাধ্যমের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়। তবে, সব মিলিয়ে, তার দেওয়া তথ্যে বিগত বছরগুলোতে গণমাধ্যমে তার অধিকাংশ উপস্থিতির হিসাব পাওয়া যায়নি।
সিএনএন-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মার্টিন এমন ১৯০টি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, যা তিনি প্রকাশ করেননি। এর মধ্যে এমন কিছু সাক্ষাৎকারও ছিল, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ডিসির অ্যাটর্নি হিসেবে দায়িত্ব পেলে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন এবং ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফেডারেল তদন্তে জড়িত ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করবেন।
মার্চ মাসে জমা দেওয়া প্রাথমিক নথিতে মার্টিন উল্লেখ করেছিলেন যে, ‘এমন কিছু তথ্য থাকতে পারে যা আমি চিহ্নিত করতে, খুঁজে বের করতে বা মনে রাখতে পারিনি।’ মঙ্গলবার জমা দেওয়া সংশোধিত তথ্যেও তিনি একই কথা উল্লেখ করে ‘ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ’ করেন।
নিয়ম অনুযায়ী, কোনো পদের জন্য মনোনীত ব্যক্তির গণমাধ্যমে উপস্থিতির কিছু তথ্য বাদ দেওয়া এবং পরে তা সংশোধন করা অস্বাভাবিক নয়। তবে মার্টিনের ক্ষেত্রে কিছু বাদ দেওয়া তথ্য বেশ গুরুতর বলে মনে হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে তিনি কোনো গণমাধ্যমে উপস্থিত ছিলেন না বলে উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু সিএনএন-এর হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর তিনি অন্তত ১২৪টি অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পডকাস্ট, রেডিও এবং টিভিতে উপস্থিত ছিলেন।
মার্টিনের দেওয়া আপডেটেড তথ্যেও কিছু অসম্পূর্ণতা ছিল। তিনি যে ওয়েব লিঙ্কগুলো সরবরাহ করেছিলেন, তার বেশিরভাগই কাজ করে না। এমনকি, একই দিনে একাধিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার তথ্যও তিনি উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
যেমন, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩-এ স্পুটনিক-এ দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের কথা তিনি উল্লেখ করেন, কিন্তু একই দিনে তার আরও তিনটি পডকাস্টে উপস্থিতির কথা জানাননি সিএনএন।
মার্টিনের ‘দ্য প্রো আমেরিকা রিপোর্ট উইথ এড মার্টিন’ নামে একটি পডকাস্ট ছিল, যা তিনি তার নথিতে উল্লেখ করেছিলেন। তবে বর্তমানে প্রধান পডকাস্টিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে এর পর্বগুলো শোনা যাচ্ছে না।
সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটিতে তথ্য জমা দেওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে, অ্যাপল পডকাস্ট এবং স্পটিফাই সহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে তার পডকাস্টের সব পর্ব অদৃশ্য হয়ে যায়। তবে, সিএনএন-এর সংগ্রহে সেই পডকাস্টগুলোর কিছু পর্ব সংরক্ষিত ছিল।
মার্টিন অবশ্য এপ্রিলের শুরুতে কমিটিতে পাঠানো এক চিঠিতে তার পডকাস্ট সরিয়ে ফেলার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি জানান, প্ল্যাটফর্মগুলো সম্ভবত তাদের ব্যবহারকারী অভিজ্ঞতা বা সংরক্ষণের জন্য তার পডকাস্ট একত্রিত করছে।
মার্টিন তার সাউন্ডক্লাউডের কিছু অংশের কথা উল্লেখ করেন, যা তিনি তার নথিতে অন্তর্ভুক্ত করেননি, তবে এখনো শোনা যায়। তিনি আরও দাবি করেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো সম্ভবত তার অজান্তে পডকাস্টের শিরোনাম এবং অংশগুলো পরিবর্তন করছে।
স্পটিফাই-এর একজন মুখপাত্র সিএনএনকে জানিয়েছেন, তারা তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে এই অনুষ্ঠান সরিয়ে দেয়নি। অ্যাপলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রকাশ না করা হওয়া সাক্ষাৎকারগুলোতে মূলত মার্টিনের কট্টর ডানপন্থী বিভিন্ন গণমাধ্যমে মন্তব্য এবং ২০২৩ ও ২০২৪ সালে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে অন্তত ২৭টি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা জানা যায়।
ওয়াশিংটন পোস্ট বুধবার এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মার্টিন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ১৫০ বারের বেশি উপস্থিত হয়েছেন। মার্টিনের একজন মুখপাত্র ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছেন, ‘জনাব মার্টিন সিনেটে পাঠানো একটি অতিরিক্ত চিঠিতে ওয়াশিংটন পোস্টের চিহ্নিত করা সব লিঙ্কের কথা উল্লেখ করেছেন।’
সিনেটের আইনপ্রণেতাদের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ডেমোক্রেট সিনেটর অ্যাডাম স্কিফ মার্টিনের মনোনয়ন আটকে দিয়েছেন। টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর জন করনিনও মার্টিনের বিষয়ে শুনানির জন্য চাপ দিচ্ছেন।
তবে, সিনেটর গ্রাসলির মুখপাত্র ক্ল্যারি স্লাটারি জানিয়েছেন, সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটি সাধারণত অ্যাটর্নি পদের জন্য মনোনীতদের বিষয়ে কোনো শুনানি করে না এবং মার্টিনকে স্ট্যান্ডার্ড মনোনয়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রয়োজনীয় সব তথ্য জানানোর জন্য বলা হয়েছে।
অতীতে মার্টিনকে বিভিন্ন বিষয়ে কঠোর মন্তব্য করতে দেখা গেছে। তিনি রক্ষণশীল বিভিন্ন বিষয়ে তার স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেছেন। বর্তমানে তার মনোনয়ন প্রক্রিয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি হিসেবে মার্টিনের মেয়াদ ২০ মে শেষ হওয়ার কথা।
তথ্য সূত্র: সিএনএন