ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভিন্ন মত: ইহুদি পরিবারগুলোতে ভাঙন। গত ৭ই অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট নিয়ে বিশ্বজুড়ে অনেক ইহুদি পরিবারে বিভেদ দেখা দিয়েছে।
ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানানোয় কারো কারো ক্ষেত্রে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। আল-জাজিরায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় বসবাস করেন ৫৬ বছর বয়সী ডালিয়া সারিগ। তিনি ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার একজন কর্মী। তার মতে, ইসরায়েল গাজায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।
ডালিয়ার বাবা-মা দুজনেই জায়নবাদী, যারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ধারণাকে সমর্থন করেন। ডালিয়ার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে তাদের মিল নেই। নিজের এই ভিন্ন মতের কারণে পরিবারের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
ডালিয়ার পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন, তা বোঝাতে গিয়ে তিনি জানান, কয়েক বছর ধরে তাদের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। একবার তিনি তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। বিদায় নেওয়ার সময় তিনি মনে মনে ধরেই নিয়েছিলেন, সম্ভবত এটাই তাদের শেষ দেখা।
কারণ, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ডালিয়া জানান, তিনি যখন ফিলিস্তিনের পক্ষে একটি বিক্ষোভের আয়োজন করেছিলেন, তখন তার বাবা বন্ধুদের কাছে বলেছিলেন, ডালিয়ার ‘মৃত্যু’ হয়েছে। এমনকি তার মাও তাকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তার রাজনৈতিক কার্যক্রমের বিরোধিতা করা হয়েছিল।
শুধু ডালিয়াই নন, এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন আরও অনেকে। ইসরায়েলের বাইরে থাকা অনেক ইহুদি পরিবার, বিশেষ করে যারা উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত, তাদের মধ্যেও এই বিভেদ দেখা যাচ্ছে। ৭ই অক্টোবরের ঘটনার পর তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানানো কমিয়ে দিয়েছেন।
বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ ইলান পাপ্পে মনে করেন, উদারপন্থী জায়নবাদীদের একটি অংশের মধ্যে ইসরায়েল ও জায়নবাদের প্রতি মোহভঙ্গ হয়েছে। ডালিয়ার পূর্বপুরুষরা ১৯৩৮ সালে নাৎসি জার্মানির আগ্রাসনের সময় অস্ট্রিয়া ছেড়ে সার্বিয়ায় চলে যান।
পরে তারা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করেন। তবে ১৯৫০-এর দশকে ডালিয়ার পরিবারের সদস্যরা আবার অস্ট্রিয়ায় ফিরে আসেন। ডালিয়া ছোটবেলায় ইহুদি উৎসব পালন করতেন এবং বয়স্কদের কাছ থেকে জায়নবাদ সম্পর্কে শুনতেন।
তাকে শেখানো হয়েছিল, ফিলিস্তিনিরা হলো শত্রু, যারা ইহুদিদের হত্যা করতে চায়। ১৮ বছর বয়সে ডালিয়া ইসরায়েলে যান এবং একটি বামপন্থী জায়নবাদী যুব আন্দোলনে যোগ দেন।
এরপর তিনি হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় এক ফিলিস্তিনি শিক্ষকের সঙ্গে পরিচিত হন, যিনি তাকে তার পরিবারের বাস্তুচ্যুত হওয়ার গল্প বলেছিলেন। এরপর ডালিয়ার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি সমর্থন জন্ম নেয়।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা শারীরিক ব্যথার মতোই মস্তিষ্কের কিছু অংশে সক্রিয়তা তৈরি করে।
এমন পরিস্থিতিতে পরিবারগুলোর মধ্যে আলোচনার জায়গা তৈরি করা প্রয়োজন। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে ভয়, অপরাধবোধ, অথবা দুঃখের মতো অনুভূতির কথা আলোচনা করা গেলে একটি সুস্থ পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
ইসরায়েলের একটি কিবুৎজে (kibbutz) জন্ম নেওয়া জোনাথন অফির নামের এক ব্যক্তি ২০০৯ সালে বুঝতে পারেন, তাকে ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। তিনি অধ্যাপক ইলান পাপ্পের লেখা ‘দ্য এথনিক ক্লিনসিং অফ প্যালেস্টাইন’ বইটি পড়েন, যা তার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল।
২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের সময় তিনি তার সমালোচনামূলক মতামত প্রকাশ করেন, যার ফলস্বরূপ পরিবারের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ে।
নেদারল্যান্ডসে বসবাস করেন ৪৪ বছর বয়সী ড্যানিয়েল ফ্রাইডম্যান। তার বাবা স্টিভেন ফ্রাইডম্যান, যিনি জায়নবাদের কট্টর সমালোচক। ড্যানিয়েলের মা একসময় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।
তবে গাজায় ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। তারা এখন রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন।
বর্তমানে, ডালিয়া সারিগ আগামী জুন মাসে ইহুদিদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করছেন, যেখানে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কথা বলা হবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা