ভেনেজুয়েলার নির্বাচনে মাদুরোর দলের বিশাল জয়, বিরোধী দলের ভোট বয়কট
ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরোর নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদীয় এবং আঞ্চলিক নির্বাচনে ভূমিধস জয়লাভ করেছে। দেশটির নির্বাচন কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তারা জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
খবরটি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা।
গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা নির্বাচনের ফলাফলকে কারচুপির অভিযোগ করে এই নির্বাচন বয়কট করার ডাক দেয়। মাদুরো সেই নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন।
নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর জানা যায়, ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ ভেনেজুয়েলা (PSUV) অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এবং সুপ্রিম কোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে, কারণ এই সংস্থাগুলোর প্রধানদের নির্বাচিত করেন ২৮৫ সদস্যের জাতীয় পরিষদ।
সোমবার দেশটির নির্বাচন কমিশন (CNE) প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, PSUV এবং তাদের মিত্ররা জাতীয় পরিষদের আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৮২.৬৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
এছাড়া, ২৪টি রাজ্যের মধ্যে ২৩টিতেই তারা গভর্নর পদও জয়লাভ করেছে।
নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্র কার্লোস কুইন্টেরো জানান, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন একটি জোট ৬.২৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে, যেখানে বিরোধী জোটের ভোট ছিল ৫.১৭ শতাংশ।
মাদুরো এই নির্বাচনের ফলকে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিজয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, এটি ‘চাভিসম’-এর শক্তি প্রমাণ করেছে।
উল্লেখ্য, হুগো চাভেজ ছিলেন এই বামপন্থী, জনপ্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।
নির্বাচন কমিশন ২৬০ জন রাজ্য আইনপ্রণেতা, ২৮৫ জন জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং ২৪ জন গভর্নরের জন্য এই নির্বাচনের আয়োজন করে।
এর মধ্যে বিতর্কিত একটি অঞ্চল, ‘এসেকুইবো’র জন্য নতুন করে গভর্নরের পদ তৈরি করা হয়। ভেনেজুয়েলা এবং প্রতিবেশী গায়ানার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে বিবাদ চলছে।
বিরোধী দলের প্রার্থীরা কোজেদেস রাজ্যের গভর্নর পদ জয়লাভ করেছেন। যদিও তারা ২০২১ সালের নির্বাচনে ৪টি রাজ্যে জয়ী হয়েছিল।
ভেনেজুয়েলা সরকার বিতর্কিত তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল এসেকুইবোর জন্য একজন গভর্নর এবং আটজন প্রতিনিধির নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী সীমানা পুনর্গঠন করেছে।
গায়ানার সঙ্গে এই অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে তাদের বিরোধ রয়েছে।
এই নির্বাচন হয় বলিভার রাজ্যের একটি ছোট জেলায়, যেখানে ২১,৪0৩ জন ভোটার ছিলেন। গায়ানা সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই এলাকাটি ভেনেজুয়েলার অংশ।
গায়ানা কর্তৃপক্ষ কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চলটি শাসন করছে, তবে কারাকাস এটিকে আংশিকভাবে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার হুমকি দিয়েছে।
ভোটের আগে গায়ানা সরকার সতর্ক করে জানায়, ভেনেজুয়েলার নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিশ্বাসঘাতকতার শামিল হতে পারে।
গত বছর মাদুরো সরকার বিতর্কিত অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য তৈরি করার আইন পাস করে, যদিও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) এই বিষয়ে মামলা চলছে।
আদালত এর আগে কারাকাসকে ওই অঞ্চলের স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের মতো কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু ভেনেজুয়েলা সরকার আদালতের এখতিয়ারকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়।
বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা মারিয়া করোনা মাচাদো রবিবার এক এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্টে জানান, দেশের কিছু অঞ্চলে প্রায় ৮৫ শতাংশ ভোটার নির্বাচন বয়কট করেছেন।
তিনি এই নির্বাচনকে ‘একটি বিশাল প্রহসন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা সরকারের ‘গত বছরের পরাজয়কে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
অন্যদিকে, এডমুন্ডো গঞ্জালেজ, যিনি যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের কাছে গত জুলাই মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হিসেবে স্বীকৃত, বলেছেন, “আজ আমরা এমন একটি ঘটনার সাক্ষী হয়েছি যা নির্বাচনের মোড়কে সাজানো হয়েছিল, কিন্তু এটি দেশ বা বিশ্বকে প্রতারিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।”
এদিকে, বিরোধী দলের আরেক অংশ, যারা দু’বারের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হেনরিকে ক্যাপ্রিলেস এবং জুলিয়া রাজ্যের গভর্নর ম্যানুয়েল রোসালেসের নেতৃত্বে ছিলেন, তারা ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান, যাতে বিরোধী দলকে সরকার থেকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়া না হয়।
ক্যাপ্রিলেস জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন, তবে রোসালেস গভর্নরের পদ হারান।
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রায় ৮৯ লাখ ভোটার ভোট দিয়েছেন, যা মোট যোগ্য ভোটারের প্রায় ৪২ শতাংশ।
তবে, দেশের প্রধান বিরোধী নেতারা গত জুলাই মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোটারদের এই নির্বাচন বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এই ফলাফল মাদুরোর জন্য একটি বড় ধরনের উৎসাহ হিসেবে কাজ করবে, কারণ এর মাধ্যমে তিনি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।
অন্যদিকে, বিরোধী দল এই নির্বাচনে হতাশ হয়েছে। বিরোধী দলের ডেমোক্রেটিক ইউনিটারি প্ল্যাটফর্মের (PUD) নির্বাহী সম্পাদক ওমর বারবোজা নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে দলীয় ঐক্যের অভাবের কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন।
আল জাজিরার হয়ে আর্জেন্টিনার প্রতিবেদক তেরেসা বো জানান, নির্বাচনের প্রচারের সময় বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এই নির্বাচন বয়কট করা নিয়ে বিভেদ ছিল, যার কারণে তারা মাদুরোর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি।
তিনি আরও যোগ করেন, বেশিরভাগ বিশ্লেষক বলেছেন যে তারা এই নির্বাচন ‘মুক্ত ও সুষ্ঠু’ হবে, এমন নিশ্চয়তা দিতে পারেননি।
মাদুরোর এই সাফল্য এমন এক সময়ে এসেছে যখন দীর্ঘদিন ধরে চলা অব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেল কোম্পানি শেভরনকে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল উত্তোলন চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রত্যাহার করেছেন, যা মাদুরো প্রশাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।
২০২২ সালে ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেনের আমলে শেভরনকে এই অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যখন মাদুরো একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার অভিবাসীদের বিতাড়নও শুরু করেছে।
তাদের মধ্যে অনেককে এল সালভাদরের একটি উচ্চ নিরাপত্তা কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।
গত সপ্তাহে, মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার ভেনেজুয়েলার অভিবাসীর বিতাড়ন সুরক্ষা বাতিল করে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা