লেবাননে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্র সমর্পণের সম্ভাবনা: নতুন মোড়?
বহু বছর ধরে লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলোতে নিজেদের মতো করে শাসনকার্য পরিচালনা করে আসছে বিভিন্ন ফিলিস্তিনি সংগঠন। ইসরায়েল কর্তৃক ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জন্য তৈরি হওয়া শরণার্থী শিবিরগুলোতে এইসব গোষ্ঠী নিরাপত্তা সহ অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে, এবং তাদের নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্রও বিদ্যমান। কিন্তু পরিস্থিতি এখন বদলাতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে। লেবাননের দুর্বল হয়ে পড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে দেশটির ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা চলছে।
ফেব্রুয়ারিতে গঠিত নতুন লেবানীয় সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের সাবেক বিচারক নাওয়াফ সালাম। এই সরকারের প্রতি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সমর্থন রয়েছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো—রাষ্ট্রবহির্ভূত সকল সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিরস্ত্রীকরণ করা। এর আওতায় আসবে ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনগুলোও। ১৯৬৯ সালের একটি চুক্তির মাধ্যমে এই সংগঠনগুলোকে লেবাননের ১২টি শরণার্থী শিবিরে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হয়েছিল।
সম্প্রতি, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস লেবানন সফরকালে অস্ত্র সমর্পণের বিষয়ে তার সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। আব্বাস এবং লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, উভয় পক্ষই একমত যে, “লেবানন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনো অস্ত্র রাখা চলবে না।” ফিলিস্তিনের প্রধান রাজনৈতিক দল ফাতাহ-এর একজন কর্মকর্তা মুস্তাফা আবু হারব আল জাজিরাকে বলেন, “আব্বাস এখানে এসেছেন একটি কথা বলতে—আমরা লেবাননে অতিথি, লেবাননের কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বে নই। লেবানন রাষ্ট্রের বাইরে অন্য কারো হাতে অস্ত্র থাকুক, এটা আমরা সমর্থন করি না।” ২০১৭ সালের পর এই প্রথম লেবানন সফরে এসে আব্বাস প্রধানমন্ত্রী সালাম এবং স্পিকার নাবিহ বেরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিরস্ত্রীকরণ এবং লেবাননে বসবাস করা প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার ফিলিস্তিনির অধিকার ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়।
ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ (UNRWA)-এর তথ্য অনুযায়ী, লেবাননে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা অনেক পেশায় কাজ করতে পারে না, তাদের সম্পত্তি বা ব্যবসা করার অধিকার নেই, সরকারি চাকরি বা স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার মতো সরকারি পরিষেবাগুলিও তারা পায় না। প্রেসিডেন্ট আব্বাস প্রেসিডেন্ট আউনের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, “আমরা আবারও বলছি, রাষ্ট্রের কাঠামোর বাইরে শরণার্থী শিবিরগুলোতে অস্ত্রের উপস্থিতি লেবাননকে দুর্বল করে এবং ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের ক্ষতি করে।”
তবে, ২০০৫ সালের পর থেকে নির্বাচনে অংশ না নেওয়া আব্বাসের ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিরস্ত্রীকরণের সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। হামাস-এর একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা আলী বারাকাহ এএফপিকে বলেন, তিনি আশা করেন আব্বাস ও আউনের মধ্যে আলোচনা শুধু ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিরস্ত্রীকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং লেবাননে বসবাস করা ফিলিস্তিনি জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার দিকেও নজর দেওয়া হবে।
অন্যদিকে, হামাস, যা হিজবুল্লাহর মতো ইরান-সমর্থিত ‘প্রতিরোধ অক্ষ’-এর অংশ হিসেবে বিবেচিত, ইতিমধ্যেই লেবানন সরকারের সঙ্গে অন্তত একবার সহযোগিতা করেছে। মে মাসে, ফিলিস্তিনের এই গোষ্ঠী ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপের অভিযোগে অভিযুক্ত এক যোদ্ধাকে লেবাননের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয় এবং এটিকে ‘ব্যক্তিগত কাজ’ হিসেবে উল্লেখ করে। তারা যুদ্ধবিরতি মেনে চলার এবং লেবানন সরকারের সঙ্গে কাজ করারও আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
আব্বাসের দুই দশকের শাসনামলে লেবাননের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা কমেছে। এটি সেখানকার শরণার্থী শিবিরগুলোতেও দৃশ্যমান। সেখানে আব্বাসের পূর্বসূরি ইয়াসির আরাফাত এবং হামাস মুখপাত্র আবু ওবায়দার ছবি বর্তমান প্রেসিডেন্টের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যায়। বৈরুতের বৃহত্তম ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির শাতিলার একজন কমিউনিটি নেতা মাজদি মাজযুব বলেন, “ফাতাহ বাদে কোনো ফিলিস্তিনিই তাকে (আব্বাসকে) আমাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনে করে না। এই প্রেসিডেন্ট আমাদের সম্মান করেন না এবং আমাদের প্রতিনিধিত্বও করেন না, কারণ তিনি দখলদারিত্বকে সমর্থন করেন এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।”
আব্বাসের জনপ্রিয়তার অভাব ছাড়াও, লেবাননে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিরস্ত্রীকরণের চেষ্টার বিরুদ্ধে আরও কিছু বিষয় প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের একজন সিনিয়র ফেলো নিকোলাস ব্লানফোর্ড বলেছেন, “যদি ফিলিস্তিনিদের অস্ত্র জমা দিতে বাধ্য করা হয়, তবে এটিকে ইসরায়েলের বিজয় হিসেবে দেখা যেতে পারে।” ব্লানফোর্ড আরও উল্লেখ করেন, সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতির পক্ষে যারা, তারা ১৯৮২ সালে ইসরায়েলের সমর্থনে খ্রিস্টান মিলিশিয়াদের হাতে সংঘটিত সাবরা ও শাতিলা গণহত্যার মতো ঘটনার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনি শরণার্থী ও লেবাননের বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিল।
তবে ব্লানফোর্ড মনে করেন, লেবাননে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অন্তত ভারী অস্ত্রশস্ত্র অপসারণের বিষয়ে ঐকমত্য বাড়ছে এবং কিছু ফিলিস্তিনি এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছে। মাজদি মাজযুব বলেন, “আমরা ফিলিস্তিনি হিসেবে অবশ্যই এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই, কারণ পরিস্থিতি বদলেছে।” মাজযুব আরও বলেন, কিছু খারাপ লোক ফিলিস্তিনি ক্যাম্পগুলোতে লেবানন রাষ্ট্রের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অপরাধ করে পার পেয়ে যায়।
লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী খুব কমই ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রবেশ করে। ২০০৭ সালে, সেনাবাহিনী উত্তর লেবাননের নাহর আল-বারেদ শিবিরে ফাতাহ আল-ইসলাম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এতে শত শত মানুষ নিহত হয় এবং শিবিরের একটি বড় অংশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাঝে মাঝে ব্যক্তিদের গ্রেফতার করতেও শিবিরে প্রবেশ করে।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি মাঝে মাঝে উত্তেজনাকর হয়ে ওঠে, যেমনটা লেবাননের অন্যান্য অংশেও দেখা যায়। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত সোমবার বৈরুতের শাতিলা শিবিরে প্রতিদ্বন্দ্বী মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে বাসিন্দাদের পালাতে হয়। ২০২৩ সালের গ্রীষ্মে, দক্ষিণ লেবাননের আইন আল-হিলওয়েহ্ শিবিরে ফাতাহ-এর এক কর্মকর্তার ওপর ব্যর্থ হত্যাচেষ্টার পর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে দুই ডজনের বেশি মানুষ নিহত হয়।
অতীতে, শরণার্থী শিবিরগুলোতে অস্ত্র রাখা প্রতিরোধের অধিকার হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু সাত দশকের বেশি সময় ধরে বাস্তুচ্যুতি ও নিরাপত্তাহীনতার পর, লেবাননের কিছু ফিলিস্তিনি মনে করেন, অস্ত্র রাখা তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষতি করছে। মাজদি মাজযুব বলেন, “ফিলিস্তিনিদের অস্ত্র এখন ফিলিস্তিনি বিপ্লবের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন, লেবানন রাষ্ট্রের সুরক্ষায় বসবাস করা আমাদের জন্য ভালো।”
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা