**মায়ানমারের বন্দী শিবিরে আটকা হাজার হাজার মানুষ: প্রতারণা চক্রের শিকার, দেশে ফেরার অনিশ্চয়তা**
মায়ানমার-থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে, যেখানে সবুজ বনানী আর শান্ত নদীর দৃশ্য, সেখানে এখন এক গভীর মানবিক সংকট। প্রতারণার শিকার হয়ে এখানে আটকা পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন দেশের তরুণ-তরুণী। ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের এখানে আনা হয়েছিল, কিন্তু এখন তাঁরা এক বিভীষিকাময় জীবনের শিকার।
প্রথমে, তাঁদের আনা হয় মায়ানমারের সীমান্ত এলাকার কিছু বন্দী শিবিরে। যেখানে তাঁদের দিন কাটছিল ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে। এখানকার সংঘবদ্ধ চক্রগুলো তাঁদের কম্পিউটার ব্যবহার করতে বাধ্য করত, বিশ্বজুড়ে থাকা নিরীহ মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য। কাজ করতে রাজি না হলে চলত মারধর, খাবার বন্ধ করে দেওয়া, এমনকি বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার মতো ঘটনা।
সম্প্রতি, থাই, চীন ও মায়ানমার কর্তৃপক্ষের যৌথ অভিযানে প্রায় ৭ হাজারের বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু মুক্তির পরেও তাঁদের দুর্ভোগ কমেনি। এই মানুষগুলোকে রাখা হয়েছে মায়ানমারের বিভিন্ন ক্যাম্পে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবার অভাব, খাবারের সংকট এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে দিন কাটছে তাঁদের।
একজন ভারতীয় নাগরিক জানিয়েছেন, তাঁর মতো প্রায় ৮০০ জন একই ক্যাম্পে বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। সেখানে ১০টি নোংরা টয়লেট ব্যবহার করতে হচ্ছে তাঁদের। অনেকেরই জ্বর ও কাশি হচ্ছে। আতঙ্কে নাম প্রকাশ করতে চান না তাঁরা। “এখানে যদি আমরা অসুস্থ হয়ে মারা যাই, তাহলে এর দায় কার?” – প্রশ্ন তাঁর।
উদ্ধার হওয়া মানুষেরা বলছেন, তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বন্দী শিবিরের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। জীবনটা যেন নরকের মতো। তাঁদের দেশে ফেরানোর জন্য দূতাবাসগুলোর সহায়তা এখনো পর্যাপ্ত নয়। চীন সরকার কিছু ফ্লাইট পরিচালনা করলেও, অন্যান্য দেশের সরকার সেভাবে এগিয়ে আসেনি।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওডিসি)-এর হিসাব অনুযায়ী, শুধু এশিয়াতেই ২০২৩ সালে অনলাইন প্রতারণার শিকার হয়ে ১৮ থেকে ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ২ লাখ কোটি থেকে ৪ লাখ কোটি বাংলাদেশি টাকা) ক্ষতি হয়েছে। এই বিশাল ক্ষতির পরিমাণ বুঝিয়ে দেয় এই প্রতারণা চক্রগুলোর বিস্তার কতখানি।
আটকে পড়া মানুষদের অধিকাংশই ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী। তাঁদের মধ্যে অনেকে ইংরেজিতেও সাবলীল। প্রতারণার শিকার হয়ে তাঁরা যখন জানতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে আসলে কী ঘটছে, তখন পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁদের বন্দী করে রাখা হয়। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাঁদের ওপর কড়া নজর রাখে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর থাইল্যান্ডের সুরক্ষা বিভাগের প্রধান সাসকিয়া কোক বলেন, “এই মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন। পরিস্থিতি সত্যিই হৃদয়বিদারক।”
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মায়ানমার বিষয়ক গবেষক জো ফ্রিম্যান বলেন, “সহিংসতার শিকার হয়ে অপরাধ করতে বাধ্য করা হলে, তাঁদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়। তবে, আমরা দেখেছি, এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রতারণা চক্র থেকে নিজেদের নাগরিকদের উদ্ধার করে তাঁদের বিরুদ্ধেই মামলা করছে।”
এই ঘটনার মূল কারণ হলো, মানব পাচার এবং জোরপূর্বক শ্রমের বিস্তার। এই চক্রগুলো দুর্বল মানুষদের টার্গেট করে, ভালো জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে। তাই, এই ধরনের প্রতারণা থেকে বাঁচতে হলে, জনগণকে সচেতন হতে হবে এবং প্রলোভন থেকে দূরে থাকতে হবে।
তথ্যসূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস