পুরুষ নীল-রেখাযুক্ত অক্টোপাসের এক অত্যাশ্চর্য কৌশল, সঙ্গমের সময় তারা তাদের সঙ্গিনীকে বিষ প্রয়োগ করে আত্মরক্ষা করে! সম্প্রতি এক গবেষণায় এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
নীল-রেখাযুক্ত অক্টোপাস (Blue-lined octopus) এক ধরনের ক্ষুদ্র, অত্যন্ত বিষাক্ত সামুদ্রিক প্রাণী। এদের প্রধান আবাসস্থল অগভীর সমুদ্র এবং উপকূলীয় অঞ্চলের কাছাকাছি। এরা টেট্রোডোটক্সিন নামক এক শক্তিশালী নিউরোটক্সিন ব্যবহার করে, যা তাদের শিকারকে কাবু করতে কাজে লাগে। এই একই বিষ ফিশ-পাফার (pufferfish)-এর শরীরেও পাওয়া যায়।
গবেষণা বলছে, পুরুষ অক্টোপাস সঙ্গমের শুরুতে খুব সূক্ষ্মভাবে কামড় বসিয়ে স্ত্রী অক্টোপাসের শরীরে এই বিষ প্রবেশ করায়। স্ত্রী অক্টোপাসগুলো সাধারণত পুরুষদের চেয়ে আকারে বেশ বড় হয়। এদের আকার একটি গলফ বলের মতো হতে পারে, যা পুরুষদের চেয়ে ২ থেকে ৫ গুণ পর্যন্ত বড় হতে দেখা যায়। কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ওয়েন-সং চুং-এর নেতৃত্বে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।
স্ত্রী অক্টোপাসগুলো সঙ্গমের সময় তাদের পুরুষ সঙ্গীকে খেয়ে ফেলার প্রবণতা দেখায়, বিশেষ করে ডিম পাড়ার সময়। ডিম পাড়ার পর তারা প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে ডিমের যত্ন নেয় এবং এই সময়ে তাদের প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। তাই, সঙ্গমের সময় পুরুষ অক্টোপাসকে আত্মরক্ষার জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতে হয়।
পুরুষ অক্টোপাসের শরীরে হেকটোকটিলাস নামে একটি বিশেষ অঙ্গ থাকে, যা দিয়ে তারা শুক্রাণু স্ত্রী অক্টোপাসের ডিম্বনালীতে স্থানান্তর করে। অনেক প্রজাতির অক্টোপাস সঙ্গমের সময় নিজেদের রক্ষার জন্য ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। উদাহরণস্বরূপ, আর্গোনট (Argonaut) নামক এক প্রকার অক্টোপাস সঙ্গমের পরে তাদের প্রজনন অঙ্গ ত্যাগ করে দেয়। অন্য প্রজাতিগুলোর হেকটোকটিলাস লম্বা হয়ে থাকে। তবে নীল-রেখাযুক্ত অক্টোপাসের হেকটোকটিলাস তুলনামূলকভাবে ছোট। তাই তারা দীর্ঘ দূরত্বে সঙ্গম করতে পারে না এবং তাদের একটি বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়।
গবেষকরা জানিয়েছেন, তারা দেখেছেন যে সঙ্গমের সময় পুরুষ অক্টোপাস স্ত্রী অক্টোপাসকে প্রায় ৪০ থেকে ৭৫ মিনিটের জন্য অবশ করে দেয়। বিষের প্রভাবে স্ত্রী অক্টোপাস প্রায় আট মিনিটের মধ্যে শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দেয়, ফ্যাকাসে হয়ে যায় এবং তাদের চোখের মণি আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা হারায়। বিজ্ঞানীরা আরও উল্লেখ করেছেন, স্ত্রী অক্টোপাস যখন তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুনরায় নাড়াচাড়া করতে সক্ষম হয় এবং পুরুষকে সরিয়ে দেয়, তখনই সঙ্গম প্রক্রিয়া শেষ হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, সঙ্গমের সময় কোনো স্ত্রী অক্টোপাসের মৃত্যু হয়নি। এমনকি, তারা স্বাভাবিকভাবেই খাবার গ্রহণ করেছে, যা টেট্রোডোটক্সিনের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধের প্রমাণ দেয়। তবে, নীল-রেখাযুক্ত অক্টোপাসের বিষ মানুষের জন্য মারাত্মক হতে পারে। এছাড়া, এই অক্টোপাস খাওয়ার কারণে সবুজ সমুদ্র কচ্ছপেরও (green sea turtles) মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
নীল-রেখাযুক্ত অক্টোপাস সহ অধিকাংশ অক্টোপাস প্রজাতিই সেমেলপ্যারিটি (semelparity) দেখায়, অর্থাৎ তারা জীবনে একবারই প্রজনন করে এবং এরপর মারা যায়। সঙ্গমের পরপরই পুরুষ অক্টোপাস মারা যায়, আর স্ত্রী অক্টোপাস ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার পরেই মারা যায়। ড. চুং এই অদ্ভুত প্রজনন কৌশলকে দুটি লিঙ্গের মধ্যে “বিবর্তনীয় প্রতিযোগিতা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কারণ, স্ত্রী অক্টোপাস আকারে বড় এবং শক্তিশালী হওয়ায় পুরুষদের তাদের জিন পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ কৌশল তৈরি করতে হয়েছে।
এই গবেষণাটি ‘কারেন্ট বায়োলজি’ (Current Biology) জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান