শিক্ষা: মানব পাচার রুখতে অপরিহার্য হাতিয়ার
আজকের বিশ্বে, মানব পাচার একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল, এমনকি অনুন্নত দেশেও এই সমস্যা বিস্তৃত। শিশুদের জোর করে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়, যা তাদের মৌলিক অধিকারের চরম লঙ্ঘন। তাদের স্কুলে যাওয়ার বদলে কাজ করতে হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই পরিস্থিতিতে, শিশুদের পাচার এবং তাদের শ্রম শোষণ বন্ধ করতে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
অধ্যাপক জোনাথন টডরেস, যিনি জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং শিশুদের অধিকার ও মানব পাচার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, তাঁর বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, মানব পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যেখানে উন্নত দেশগুলোও পিছিয়ে নেই। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা হয়। কলকারখানা, কৃষি, খনিজ উত্তোলন, নির্মাণ এবং মৎস্য শিল্পে তাদের ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে, শিশুরা তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য কাজ করতে বাধ্য হয়।
শিক্ষাই পারে এই চক্র ভাঙতে। নেলসন ম্যান্ডেলার বিখ্যাত উক্তিটি এক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক: “শিক্ষা হল সেই শক্তিশালী অস্ত্র যা দিয়ে বিশ্বকে পরিবর্তন করা যায়।” শিক্ষার মাধ্যমে একটি শিশু দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং উন্নত জীবনের দিকে অগ্রসর হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে শিশুরা দীর্ঘ সময় ধরে স্কুলে যায়, তাদের শোষিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে। বর্তমানে, বিশ্বজুড়ে ৮৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে, কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে মাত্র ৫৯ শতাংশ। এর মানে হল, এখনো অনেক শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং তারা পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করতে হবে। শুধু টিউশন ফি-ই নয়, বই, পোশাক এবং পরিবহনের মতো আনুষঙ্গিক খরচও কমাতে হবে, যাতে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা সহজে স্কুলে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে সকালের জলখাবার ও দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যা শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি বাড়াতে সহায়ক হবে। উন্নত দেশগুলোতেও এই ধরনের কর্মসূচি শিশুদের পড়াশোনার মান উন্নত করতে সাহায্য করে।
শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের মান উন্নয়ন করাও জরুরি। পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনেক শিশু ভালো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। বড় ক্লাসরুম এবং শিক্ষকদের ওপর অতিরিক্ত কাজের চাপ পড়লে, শিশুদের ঝরে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের উন্নয়নে বিনিয়োগ করলে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ে এবং শিশুদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখা সহজ হয়।
সবশেষে, দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোকে সহায়তা করার জন্য উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ব্রাজিলের ‘বোলসা ফ্যামিলিয়া’ প্রোগ্রামের মতো নগদ অর্থ প্রদান কর্মসূচি এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। এর ফলে, পরিবারের উপর শিশুদের কাজের চাপ কমে এবং তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।
অবশ্যই, শিশুদের পাচার বন্ধ করতে হলে একটি শক্তিশালী আইন কাঠামো তৈরি এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের শোষণ থেকে রক্ষা করতে এবং অপরাধীদের জবাবদিহি করতে হবে। তবে, শিক্ষার উপর জোর দেওয়া শুধু শিশুদের বর্তমান জীবনকে রক্ষা করবে না, বরং তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের পথও সুগম করবে। তারা যাতে একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত কর্মসংস্থান খুঁজে পায়, সেই লক্ষ্যে তাদের প্রস্তুত করবে শিক্ষা।
এক্ষেত্রে, আমাদের মনে রাখতে হবে, মানব পাচার প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর মধ্যে একটি হল শিশুদের বিনামূল্যে, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। মানব পাচার বিরোধী লড়াইয়ে শামিল হতে হলে, প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন