ট্রাম্পের ‘খনন করো, বেবি, খনন করো’ নীতি: জীবাশ্ম জ্বালানির উপর বিশ্বকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘খনন করো, বেবি, খনন করো’ – এই স্লোগানটি শুধু একটি আহ্বানে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল তার বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। তিনি চেয়েছিলেন বিশ্বকে দীর্ঘ সময় ধরে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল রাখতে। জাপান ও ইউক্রেনের মতো দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ট্রাম্প শুল্ক এবং সামরিক সহায়তার মতো বিষয়গুলো ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এমনকি আফ্রিকার দেশগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে সবচেয়ে দূষিত কয়লার ব্যবহার পুনরায় চালু করার পক্ষেও তিনি ওকালতি করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি সচিব ক্রিস রাইট গত সপ্তাহে বলেছিলেন, “পশ্চিমা দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে নির্লজ্জভাবে বলে আসছে, ‘কয়লা ব্যবহার করো না, কয়লা খারাপ'”। তিনি আরও যোগ করেন যে, এই ধরনের মনোভাব আফ্রিকার জন্য ‘পিতৃতান্ত্রিক’ এবং ফলপ্রসূ ছিল না। রাইট এর তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, “কয়লা আমাদের বিশ্বকে উন্নত করেছে।”
টেক্সাসের হিউস্টনে অনুষ্ঠিত ‘সেরা উইক’ তেল শিল্প সম্মেলনেও রাইট তার এই যুক্তির পুনরাবৃত্তি করেন। সেখানে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে জো বাইডেনের ‘অযৌক্তিক, ধর্মীয় নীতির’ সমালোচনা করেন এবং বলেন, সৌর ও বাতাসের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি কোনোভাবেই জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হতে পারে না। যদিও বিশেষজ্ঞরা তার এই দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।
ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে বিশ্বকে দীর্ঘমেয়াদে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল রাখার কথা বলা হয়েছে, তাতে আফ্রিকার দেশগুলোতে খনন কার্যক্রমের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আরও বাড়তে পারে। এই নীতি সেইসব ব্যবসায়ী মহলের জন্য আনন্দের কারণ হবে, যারা মনে করেন তেল ও গ্যাসই হলো আফ্রিকার ৬০০ মিলিয়ন মানুষের বিদ্যুতের অভাব দূর করার একমাত্র উপায়।
স্ট্রিক গ্লোবাল ডিপ্লোমাসির চেয়ারম্যান রবার্ট স্ট্রিক বলেছেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিধিনিষেধ শিথিল করার ফলে, মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য আফ্রিকার তেল ও গ্যাস খাতে যুক্ত হওয়ার নতুন সুযোগ তৈরি হবে। এটি আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য সত্যিকারের সুবিধা নিয়ে আসার সম্ভাবনা রাখে।” তিনি আরও বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর উচিত হবে না আফ্রিকার দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে থাকতে বলতে, কারণ তারাই একসময় কয়লা, তেল ও গ্যাস ব্যবহার করে তাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। “আফ্রিকা তার নিজের ভাগ্য বেছে নিক,” তিনি যোগ করেন।
বিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার জলবায়ু সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এর ফলে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে দরিদ্র আফ্রিকান দেশগুলোতে বিপর্যয়কর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশে বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে দ্রুত হারে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং এর ফলস্বরূপ বন্যা, খরা ও তীব্র তাপপ্রবাহের মতো ঘটনাগুলো আরও বাড়ছে। এর কারণে দেশগুলো তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ পর্যন্ত হারাচ্ছে।
পাওয়ার শিফট আফ্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মোহাম্মদ আডোর মতে, “মার্কিন জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং আফ্রিকার দরিদ্র ও দুর্বল মানুষ চরম আবহাওয়া, ঘরবাড়ি হারানো এবং জীবিকার সংকটে পড়ছে।” তিনি আরও বলেন, “মার্কিন জ্বালানি সচিব কয়লার পক্ষে কথা বলছেন, যা বিশাল অজ্ঞতার পরিচয়। একইসঙ্গে এটি মার্কিন জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে রাজনীতিবিদদের প্রভাবিত করার একটি স্পষ্ট উদাহরণ।”
আডোর উল্লেখ করেন, আফ্রিকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরি করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ধনী দেশগুলোর সহায়তা প্রয়োজন। তবে, এই ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করতে পিছিয়ে রয়েছে। ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য একটি প্রকল্প বাতিল করেছেন, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির দিকে যেতে সহায়তা করত। এছাড়াও, তিনি জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন।
ইউক্রেনের সঙ্গে একটি চুক্তির আলোচনা চলছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেশটির খনিজ পদার্থের প্রবেশাধিকার থাকবে। এই খনিজগুলোর মধ্যে তেল ও গ্যাস ছাড়াও গ্রাফাইটের মতো উপাদানও রয়েছে, যা ব্যাটারিতে ব্যবহৃত হয়। এই চুক্তি ট্রাম্পের ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারে।
ইউক্রেন, এমনকি রাশিয়ার আক্রমণের মধ্যেও, তাদের পরিচ্ছন্ন জ্বালানি অবকাঠামো তৈরির চেষ্টা করছে। তবে নতুন এই চুক্তি সেই অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এমন মন্তব্য করে ইউক্রেনীয় পরিবেশ আইনজীবী এবং ‘রাজম উই স্ট্যান্ড’-এর নির্বাহী পরিচালক স্ভিতলানা রোমানকো বলেন, “ট্রাম্পের এই নব্য-উপনিবেশিক খনিজ সম্পদ দখলের ফলে ইউক্রেন একটি করদ রাজ্যে পরিণত হবে এবং জলবায়ু সংকট আরও বাড়বে।”
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ জোনাথন এলকিন্ড বলেন, “বিশ্বজুড়ে দেশ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো জলবায়ু সংকট থেকে উত্তরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। তবে ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি সমর্থন হ্রাস এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তহবিল কমানোর পদক্ষেপগুলো কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান