যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত হয়ে গুয়ানতানামো বে’র বন্দী শিবিরে ১৫ দিন কাটানো এক ভেনেজুয়েলার নাগরিকের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানা গেছে। নির্যাতনের বিভীষিকা নিয়ে সম্প্রতি মুখ খুলেছেন হোসে ড্যানিয়েল সিম্যানকাস রদ্রিগেজ নামের ওই ব্যক্তি। নির্যাতনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি আজও তাড়া করে ফেরে তাকে।
হোসে ড্যানিয়েল জানান, তাকে এবং আরও কয়েকজন ভেনেজুয়েলার নাগরিককে হাতকড়া ও পায়ের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে একটি বিমানে তোলা হয়। তাদের বলা হয়েছিল, মিয়ামীতে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর বিমানটি যখন অবতরণ করে, তখন তাদের বাসে করে একটি বন্দী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাসের জানালাগুলো কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল। এরপরই তিনি বুঝতে পারেন, তারা গুয়ানতানামো বে’তে পৌঁছেছেন। কিন্তু ১৫ দিনের এই দুঃস্বপ্নের শুরুটা যে এতটা বিভীষিকাময় হবে, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।
হোসে ড্যানিয়েল জানান, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশী ১৭৭ জন ভেনেজুয়েলার নাগরিককে কিউবার এই নৌ căn cứ-তে (বেস)-এ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে জানায়, অভিবাসীদের রাখার জন্য এই স্থানটি উপযুক্ত নয়। বন্দী শিবিরে থাকাকালীন সময়ে তার ওপর চলা অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সেখানে একটি মাত্র তোশক ও বালিশ ছিল। পর্যাপ্ত খাবারও ছিল না। তাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। দিনের আলো কিংবা রাতের অন্ধকারে তিনি কিছুই বুঝতে পারতেন না। তার “নরক”-এর মতো বন্দী জীবনে একমাত্র সঙ্গী ছিল অন্য বন্দীদের আর্তচিৎকার। এই পরিস্থিতি এতটাই অসহনীয় ছিল যে, আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন তিনি।
হোসে ড্যানিয়েলের বয়স বর্তমানে ৩০ বছর। তিনি জানান, তাকে একসময় জানানো হয়েছিল যে, তিনি দেশে ফিরতে পারবেন। কিন্তু পাঁচ সন্তানের মুখ তিনি আর দেখতে পাবেন কিনা, তা নিয়ে তিনি ছিলেন চরম হতাশায়। তিনি আরও বলেন, “নির্যাতন মানেই হলো বন্দী করে রাখা। সেখানে বেঁচে থাকার কোনো মানে থাকে না। দিন-রাতের কোনো ধারণা থাকে না, সময় কিভাবে কাটে, সেটাও বোঝা যায় না। খাবার জোটে সামান্য, প্রতিটা দিন যেন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া। ১৫ দিন বন্দী থাকার সময় আমি প্রতিদিন কেঁদেছি।”
হোসে ড্যানিয়েল জানান, বন্দী অবস্থায় ১৫ দিনে তাকে মাত্র দু’বার গোসল করতে দেওয়া হয়েছিল। গোসলের সময়ও তার হাতে হাতকড়া পরানো হতো এবং নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে কড়া নজরদারিতে রাখত। তার মনে হতো, তিনি যেন একজন সন্ত্রাসী।
গুয়ানতানামো বে’তে থাকাকালীন ক্ষুধার কষ্টটা এখনো তার মনে আছে। দিনে তিন বেলা খাবার দেওয়া হলেও, সেগুলোর স্বাদ তার মনে নেই। খাবারগুলো পরিমাণে খুবই সামান্য ছিল। তিনি বলেন, “আমি প্লেট চেটে পরিষ্কার করতাম। কারণ আমি খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম।”
হোসে ড্যানিয়েল জানান, তিনি ২০১৯ সালের মে মাসে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। এর আগে তিনি ইকুয়েডরে থাকতেন। এরপর পানামা, কোস্টারিকা এবং মেক্সিকো হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে যাত্রা করেন। তার স্বপ্ন ছিল, সেখানে গিয়ে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর আট দিন একটি ফেডারেল কারাগারে এবং নয় মাস টেক্সাসের এল পাসোর একটি ডিটেনশন সেন্টারে বন্দী থাকতে হয়। অভিবাসন কর্মকর্তাদের জেরার সময় তিনি জানান, তার জন্ম ভেনেজুয়েলার মারাকাইয়ে। সম্ভবত এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা তাকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কারণ, তার শরীরে ছিল পুরোনো কিছু ট্যাটু। কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, ভেনেজুয়েলার একটি কুখ্যাত অপরাধী চক্র ‘ট্রেন দে আরাগুয়া’র সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকতে পারে।
হোসে ড্যানিয়েল জানান, গুয়ানতানামো বে’তে বন্দী থাকা ১৫ জনের একটি দলের সদস্য ছিলেন তিনি। তাদের মিয়ামীতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও, সেখানে তাদের বন্দী করে রাখা হয়।
অবশেষে, ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে গুয়ানতানামো বে’র সামরিক ঘাঁটি থেকে মুক্তি পান তিনি। এরপর তাকে হন্ডুরাসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা কনভিয়াসার একটি বিমানে করে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এই ঘটনার পর জানান, যারা “অকারণে” গুয়ানতানামো বে’তে বন্দী ছিলেন, তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য তিনি আবেদন করেছিলেন।
বর্তমানে হোসে ড্যানিয়েল তার পরিবার ও মায়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। তিনি জানান, সন্তানদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এখন তিনি নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে চান।
তথ্যসূত্র: সিএনএন