ইউক্রেন যুদ্ধ: শান্তি আলোচনার সম্ভবনা এবং আন্তর্জাতিক চাপ
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন যে কিয়েভ যদি মার্কিন প্রস্তাব মেনে নেয়, তবে যুদ্ধ দ্রুত বন্ধ করার “ভালো সুযোগ” রয়েছে। তবে রাশিয়া জানিয়েছে, তারা কিছু শর্ত পূরণ হলে তবেই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবে। জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মিত্র দেশগুলোকে মস্কোর উপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যতদূর সম্ভব যুদ্ধবিরতি বিলম্বিত করতে চাইবেন।
জেলেনস্কি সাংবাদিকদের বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যদি জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে তারা (রাশিয়া) খেলা করতে পারবে না। আর রাশিয়া যদি এমন কিছু পদক্ষেপ নেয় যা তারা ভয় পায় না, তবে তারা আলোচনা দীর্ঘায়িত করবে।” তিনি আরও যোগ করেন যে, পুতিন “অন্তহীন আলোচনার দিকে সবাইকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন… যেখানে তার বন্দুকগুলো মানুষ মারতেই থাকবে।”
অন্যদিকে, রুশ সীমান্তবর্তী কুর্স্ক অঞ্চলের ইউক্রেনীয় সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেছেন, আত্মসমর্পণ করলে তাদের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে আচরণ করা হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও পুতিনের কাছে সৈন্যদের জীবন বাঁচানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ট্রাম্পের এক দূত রুশ নেতার সঙ্গে প্রস্তাবিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি নিয়ে “খুব ভালো ও ফলপ্রসূ” আলোচনা করেছেন বলেও জানান তিনি।
গত এক সপ্তাহে কুর্স্কে রাশিয়ার পাল্টা আক্রমণে ইউক্রেনীয় বাহিনী তাদের কিছু এলাকা হারিয়েছে যা তারা গত আগস্টে রাশিয়ার পশ্চিমা সীমান্ত অঞ্চল থেকে দখল করেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে এই এলাকাগুলো দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল।
পুতিন রুশ টেলিভিশনে প্রচারিত বক্তব্যে বলেন, “আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আহ্বানে সহানুভূতিশীল”। তিনি আরও বলেন, “যদি তারা অস্ত্র সমর্পণ করে এবং আত্মসমর্পণ করে, তবে তাদের জীবন ও সম্মানের সঙ্গে ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।” ট্রাম্প বলেছেন, “হাজার হাজার” ইউক্রেনীয় সৈন্য “রুশ সামরিক বাহিনীর দ্বারা সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ এবং খুবই খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছে।” পুতিন অবশ্য মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করতে “সবকিছু করার” জন্য ট্রাম্পের প্রশংসা করেছেন।
ইউক্রেনের সামরিক নেতৃত্ব অবশ্য মাঠের এই দাবি অস্বীকার করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা জানায়, “আমাদের ইউনিটের ঘেরাও হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।” জেলেনস্কিও কুর্স্ক অঞ্চলের পরিস্থিতিকে “অবশ্যই খুবই কঠিন” বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই অভিযান এখনও মূল্যবান। ইউক্রেনের সূত্র ও সামরিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, কুর্স্কে সৈন্যদের ব্যাপক সংখ্যায় ঘেরাও করার বিষয়ে ট্রাম্পের দাবি সঠিক নয়।
এদিকে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার শনিবার প্রায় ২৫ জন বিশ্বনেতাকে ইউক্রেনকে সমর্থন এবং পুতিনের উপর যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিতে আহ্বান জানাবেন। স্টারমার আশা করছেন, শনিবারের ভিডিও কলে “ইচ্ছুক জোট” ইউক্রেনের জন্য সহায়তা দেওয়ার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেবে, যা শান্তি চুক্তির দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য হলো ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং নিউজিল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন প্রদর্শন করা। স্টারমার কিয়েভের জন্য লজিস্টিক্যাল, আর্থিক বা সামরিক সহায়তার প্রস্তাব চাইবেন, যাতে তারা আলোচনার টেবিলে শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে পারে।
জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য নতুন করে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, নিষেধাজ্ঞাগুলোর মধ্যে “তেলের দামের সীমা নির্ধারণ এবং ইউক্রেনকে অতিরিক্ত সহায়তা প্রদানসহ অন্যান্য ব্যবস্থা” অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। ফ্রান্স ও জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি বানচাল করার চেষ্টা করার অভিযোগ এনেছে। স্টারমার বলেছেন, মস্কো ট্রাম্পের প্রস্তাবের প্রতি “পূর্ণ অবজ্ঞা” দেখিয়েছে।
যুদ্ধ পরিস্থিতির মাঝে, শুক্রবার রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের মধ্যাঞ্চলীয় শহর ক্রিভি রিহ-এর একটি আবাসিক এলাকায় আঘাত হানে। এতে দুইজন শিশুসহ ১১ জন আহত হয়েছে বলে আঞ্চলিক গভর্নর জানিয়েছেন। টেলিগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, ব্যক্তিগত বাড়ি এবং একটি বাণিজ্যিক ভবনের ছবি পোস্ট করেছেন সের্হি লিসাক। ক্রিভি রিহ শহরের সামরিক প্রশাসনের প্রধান ওলেক্সান্ডার ভিলকুল জানিয়েছেন, দুটি স্থানে সরাসরি আঘাত হেনেছে ক্ষেপণাস্ত্র। হামলার শিকার হওয়া স্থানগুলোর মধ্যে একটি ছিল নাইট ক্লাব। এছাড়া, দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন অঞ্চলে রাশিয়ান গাইডেড বোমা হামলায় একটি আবাসিক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে একজন নিহত হয়েছে। কৃষ্ণ সাগরের নিকটবর্তী শহর ওডেসার কাছে, রাশিয়ান ড্রোন হামলা চালানো হয় চোরনোমর্স্ক বন্দরে। এতে শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা কেসিএনএ জানিয়েছে, রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই রুডেনকো উত্তর কোরিয়া সফর করছেন। ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তাদের মতে, রাশিয়ান বাহিনীকে সহায়তার জন্য হাজার হাজার উত্তর কোরীয় সৈন্যকে ইউক্রেনে মোতায়েন করা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কাজা কাল্লাস প্রস্তাব করেছেন যে, ২৭ জাতির এই জোট ইউক্রেনকে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ইউরোর (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ লক্ষ ৭৩ হাজার কোটি টাকা) নতুন সামরিক সহায়তা সরবরাহ করবে। এছাড়া, শীর্ষস্থানীয় ইইউ কূটনীতিকরা শুক্রবার পুতিনসহ প্রায় ২,০০০ রুশ নাগরিকের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান