গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান: নেতানিয়াহুর ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ গড়ার স্বপ্ন কতদূর?
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম সিএনএন-এর একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান আরও জোরদার হওয়ার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র বদলের’ উচ্চাকাঙ্ক্ষা। নেতানিয়াহু এই যুদ্ধকে ‘পুনর্জন্মের যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে বিশ্লেষকদের মতে, কৌশলগত দিক থেকে নেতানিয়াহু কতটা সফল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বর্তমানে লেবানন, সিরিয়া ও গাজায় সক্রিয় রয়েছে। নেতানিয়াহু এই তিনটি অঞ্চলের বিশাল এলাকাকে সামরিকীকরণের পরিকল্পনা করেছেন। হোয়াইট হাউসের সমর্থন নিয়ে গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা সম্ভবত কয়েক মাস বা বছর পর্যন্ত চলতে পারে। তবে প্রাক্তন ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সিএনএনকে জানিয়েছেন, নেতানিয়াহু একজন দক্ষ কৌশলবিদ হলেও, দূরদর্শী পরিকল্পনাকারী নন।
গাজার পরিস্থিতি সবচেয়ে কঠিন এবং জটিল। নেতানিয়াহু হামাসের বিরুদ্ধে ‘পূর্ণ বিজয়’ চান, যদিও সামরিক কর্মকর্তারা একে নিছক একটি শ্লোগান হিসেবেই দেখছেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে নেতানিয়াহু কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা দেননি, তবে হামাস বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে গাজার শাসন চান না, তা স্পষ্ট করেছেন।
অবসরপ্রাপ্ত ইসরায়েলি জেনারেল ইসরায়েল জিভ সিএনএনকে বলেছেন, “সরকার (গাজায়) তাদের লক্ষ্যে সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। এমনকি সেনাবাহিনী এবং জনসাধারণের কাছেও এটা স্পষ্ট নয় যে সরকার আসলে কী চায়।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাব ছিল, ফিলিস্তিনিরা যেন গাজা ত্যাগ করে। নেতানিয়াহু এই পরিকল্পনার সমর্থন করেন। তবে মন্ত্রিসভা গাজা থেকে ‘স্বেচ্ছায়’ চলে যেতে ইচ্ছুক ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি সংস্থা তৈরি করলেও, এই ধরনের পদক্ষেপকে জাতিগত নিধন হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এদিকে, হামাসের হাতে জিম্মিদের মুক্তি দেয়ার বিষয়ে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দিয়ে ইসরায়েল আবারও কঠোর অবস্থানে ফিরেছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, “এখন থেকে আলোচনা কেবল আগুনের মধ্যে হবে।”
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গাজায় “অঞ্চলটির স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণের” জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতিদিন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনিদের তাদের আশ্রয়স্থল ত্যাগ করার নির্দেশ দিচ্ছে। নেতানিয়াহু বুধবার ইসরায়েলি পার্লামেন্টে বলেছেন, এই অভিযানে “অঞ্চল দখল এবং অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা আমি এখানে বিস্তারিত বলব না।”
ইসরায়েলের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আইয়াল হুলাতা সিএনএনকে বলেছেন, “যদি এটি (অভিযান) নতুন আলোচনার দিকে না যায়, তবে তা খুবই খারাপ হবে। আমরা সেখানে আইডিএফ-এর (ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স) একটি স্থায়ী উপস্থিতি দেখতে পাব।”
গাজার দীর্ঘমেয়াদী দখলদারিত্ব এবং একজন ইসরায়েলি সামরিক গভর্নরের মাধ্যমে সেখানকার দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে আর্থিক সহায়তার আশা করা হচ্ছে।
গাজার পরিস্থিতি ইসরায়েলের জন্য বেশ কিছু অজানা বিষয় নিয়ে এসেছে। নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত। গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগও উঠেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।
যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে গাজায় মানবিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এখানকার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দিচ্ছে, যার ফলে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা (আনরওয়া)-কে (UNRWA) দুর্বল করার চেষ্টা চলছে, যারা ফিলিস্তিনিদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান সরবরাহ করে থাকে।
গাজায় হামাসের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়লেও, ইসরায়েলের প্রতি তাদের ধারণা আরও কঠিন হয়েছে।
গাজা দখলের কারণে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রেও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সৌদি কর্মকর্তারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
ইসরায়েলের এই সামরিক পদক্ষেপের কারণে লেবানন, সিরিয়া ও পশ্চিম তীরেও উত্তেজনা বেড়েছে।
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন একটি বিতর্কিত বিষয়। বর্তমানে সেখানে ১৫০টির বেশি সরকারি বসতি রয়েছে। সরকার সেখানে বসবাসকারী ইহুদিদের জন্য বৃহত্তর অঞ্চলকে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে।
ইরান ইস্যুতেও নেতানিয়াহু উদ্বিগ্ন। তিনি ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘমেয়াদী হুমকি হিসেবে দেখেন। ইরানের পরমাণু স্থাপনায় সম্ভাব্য হামলা চালানোর জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন।
তবে ট্রাম্পের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক নিয়ে নেতানিয়াহুর ভিন্নমত রয়েছে। ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে একটি সমঝোতা করতে আগ্রহী।
তথ্য সূত্র: সিএনএন