শিরোনাম: আলঝেইমার শনাক্তকরণে নতুন রক্ত পরীক্ষা, গবেষণায় মিলল আশা
স্মৃতিভ্রংশতা এবং চিন্তাভাবনার সমস্যা নিয়ে যারা ভুগছেন, তাদের আলঝেইমার রোগ আছে কিনা, তা শনাক্ত করতে এবং রোগের অগ্রগতি নিরীক্ষণের জন্য একটি নতুন রক্ত পরীক্ষার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন গবেষকরা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত ওষুধ নির্বাচন করা সহজ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, ডোনানেমাব (donanemab) এবং লেকানেমাব (lecanemab)-এর মতো নতুন ওষুধগুলো রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে এর গতি কমাতে সহায়ক হতে পারে।
সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অস্কার হানসন (Oskar Hansson), যিনি এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি জানান, “বর্তমানে অনেক দেশ আলঝেইমারের চিকিৎসার জন্য অ্যামাইলয়েড-লক্ষ্যযুক্ত থেরাপি (amyloid-targeted therapies) ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। তাই, সঠিক এবং সাশ্রয়ী মূল্যের আলঝেইমার রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা এখন অনেক বেশি।”
আলঝেইমার রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মস্তিষ্কে ‘অ্যামাইলয়েড বিটা’ নামক প্রোটিনের জমাট বাঁধা এবং ‘টাউ’ নামক অন্য একটি প্রোটিনের জট তৈরি হওয়া।
*নেচার মেডিসিন* জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হানসন ও তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, তারা রক্তের মধ্যে ‘ইএমটিবিআর-টাউ243’ (eMTBR-tau243) নামক টাউ প্রোটিনের একটি ক্ষুদ্র অংশ (fragment) শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
যাদের আলঝেইমার রয়েছে, তাদের মস্তিষ্কে টাউ-এর জট বাঁধার সঙ্গে এর একটি সম্পর্কও খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই ধরনের সম্পর্ক দেখা যায়নি।
গবেষণায় মোট ৯০২ জন অংশগ্রহণকারীর ওপর পরীক্ষা চালানো হয়।
এই পরীক্ষায় দেখা গেছে, যাদের স্মৃতিভ্রংশতার প্রাথমিক লক্ষণ রয়েছে, তাদের মধ্যে ‘ইএমটিবিআর-টাউ243’-এর মাত্রা বেশি ছিল। এমনকি, যাদের স্মৃতিভ্রংশতা (dementia) গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাদের ক্ষেত্রে এই মাত্রা আরও বেশি ছিল।
তবে, অন্য কোনো কারণে স্মৃতি দুর্বল হয়ে যাওয়া রোগীদের মধ্যে এই মাত্রা বাড়েনি।
এই গবেষণা সম্পর্কে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোডিজেনারেশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তারা স্পিয়ার্স-জোন্স (Tara Spires-Jones), যিনি এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন না, তিনি বলেন, “বৈজ্ঞানিকভাবে, এই ফলাফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কারণ, বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে এই নতুন চিহ্নিতকারী (marker) ভালো ফল দিয়েছে।
এমনকি নতুন ওষুধ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও এটি কাজে আসতে পারে।” তবে তিনি এও যোগ করেন, “এটি আলঝেইমারের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য রক্ত পরীক্ষা নয়।
কারণ, এটি বিশেষায়িত পরীক্ষাগারে উপলব্ধ জটিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। তাই, আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সহজলভ্য করার আগ পর্যন্ত এই পরীক্ষা নিয়মিতভাবে সবার জন্য সহজলভ্য নাও হতে পারে।”
আলঝেইমার্স রিসার্চ ইউকে-এর গবেষণা প্রধান ড. শিয়োনা স্কেলস (Sheona Scales) জানিয়েছেন, ‘ইএমটিবিআর-টাউ243’ হলো এমন কয়েকটি বায়োমার্কারের মধ্যে একটি, যা আলঝেইমারের রক্ত পরীক্ষার জন্য বর্তমানে গবেষণা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রক্তের এই ‘ইএমটিবিআর-টাউ243’-এর মাত্রা একজন ব্যক্তির স্মৃতি এবং চিন্তাভাবনার ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
বর্তমানে, মস্তিষ্কের ইমেজিং-এর মাধ্যমে টাউ-এর জটের স্তর এবং জ্ঞানীয় দুর্বলতার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা সবসময় সম্ভব হয় না।
তবে, এমন রক্ত পরীক্ষা রোগের অগ্রগতি নিরীক্ষণে সাহায্য করবে এবং ভবিষ্যতে রোগ নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এছাড়াও, *নেচার মেডিসিন*-এ প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় জানা গেছে, মস্তিষ্কের তরলে (brain fluid) দুটি প্রোটিনের অনুপাত (ratio) আলঝেইমার রোগীদের জ্ঞানীয় দুর্বলতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
এখানে অ্যামাইলয়েড বিটা প্লেক (amyloid beta plaques) এবং টাউ জটের (tau tangles) পরিমাণের ওপর এর কোনো প্রভাব নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের ৩,৩৯৭ জন মানুষের নমুনা ব্যবহার করা হয়।
পরীক্ষায় মস্তিষ্কের নিউরনের সংযোগস্থলে (synapses) পাওয়া যায় এমন দুটি প্রোটিন – ওয়াইএইচএজি (YWHAG) এবং এনপিটিএক্স২ (NPTX2)-এর মাত্রা দেখা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ওয়াইএইচএজি:এনপিটিএক্স২-এর অনুপাত, অ্যামাইলয়েড বিটা এবং টাউ-এর পরিমাণের চেয়ে মানুষের জ্ঞানীয় সমস্যা নির্দেশ করতে বেশি সক্ষম।
এমনকি, এটি ভবিষ্যতে জ্ঞানীয় দুর্বলতা এবং স্মৃতিভ্রংশতা শুরু হওয়ার পূর্বাভাস দিতেও কাজে লাগতে পারে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টনি ওয়াইস-কোরি (Tony Wyss-Coray), যিনি এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বলেন, “এই ফলাফল ব্যক্তি বিশেষের জন্য সেরা ওষুধ নির্বাচন করতে এবং উপযুক্ত অংশগ্রহণকারীদের বাছাই করে উন্নত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ডিজাইন করতে সাহায্য করতে পারে।”
তথ্যসূত্র: The Guardian