ওডিসি: এক মহাকাব্যের পুনরুত্থান, কেন আজও প্রাসঙ্গিক?
হোমারের কালজয়ী মহাকাব্য ‘ওডিসি’ যেন আবারও ফিরে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রাচীন গ্রিক বীর ওডিসিউসের ট্রয় যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার দীর্ঘ, বিপদসংকুল যাত্রা নিয়ে লেখা এই আখ্যান আজও মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করে। সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি নতুন অনুবাদ এবং দুটি চলচ্চিত্রের হাত ধরে ওডিসির গল্প নতুন করে উন্মোচিত হচ্ছে, যা প্রমাণ করে এই প্রাচীন সাহিত্যকর্ম আজও কতটা প্রাসঙ্গিক।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে, ওডিসি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল। ট্রয় যুদ্ধের অবসানের পর ওডিসিউসের নিজের রাজ্য ইথাকায় প্রত্যাবর্তনের কাহিনি এটি। এই মহাকাব্যে একদিকে যেমন বীরত্ব, সাহসিকতা, এবং সমুদ্র-অভিযানের বর্ণনা রয়েছে, তেমনই রয়েছে যুদ্ধের বিভীষিকা, প্রিয়জন হারানোর বেদনা, এবং বহু বছর পর ঘরে ফেরার আকাঙ্ক্ষা।
সাম্প্রতিক সময়ে, ওডিসির প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে দুটি প্রধান কারণে। প্রথমত, ক্লাসিক্যাল সাহিত্য নিয়ে কাজ করা লেখক এমিলি উইলসন ২০১৭ সালে এর একটি নতুন অনুবাদ প্রকাশ করেন, যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর অনুবাদে নারীর ক্ষমতায়ন এবং সমাজের ক্ষমতা কাঠামো নিয়ে ওডিসির বক্তব্যকে তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, লেখক ড্যানিয়েল মেন্ডেলসনের নতুন অনুবাদ, যা এই মাসের শেষে প্রকাশিত হতে চলেছে। মেন্ডেলসন ওডিসির গভীরতা এবং জটিলতাকে তুলে ধরতে মূল গ্রিক ভাষার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছেন।
শুধু অনুবাদই নয়, সিনেমাতেও ওডিসির গল্প নতুন রূপ পাচ্ছে। ক্রিস্টোফার নোলান-এর পরিচালনায় ম্যাট ডেমনের অভিনয় করা একটি চলচ্চিত্র মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। অন্যদিকে, উবের্তো পাসোলিনি’র ‘দ্য রিটার্ন’ ছবিতে রালফ ফাইনস ও জুলিয়েট বিনোশ অভিনীত ওডিসির গল্প যুদ্ধের ক্ষত এবং পরিবারের অপেক্ষার প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে চিত্রিত হয়েছে। এই ছবিতে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং যোদ্ধাদের মানসিক অবস্থা গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ওডিসির এই পুনরুত্থান আসলে সময়ের প্রতিচ্ছবি। ড্যানিয়েল মেন্ডেলসনের মতে, ওডিসি সম্ভবত একটি ‘উত্তর-রাজনৈতিক’ সময়ের গল্প, যেখানে পুরনো অনেক ধারণা ভেঙে গেছে। যুদ্ধের পরে মানুষ যখন নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চাইছে, তখন ওডিসির গল্প তাদের কাছে নতুন আলো দেখাচ্ছে। যুদ্ধের বিভীষিকা এবং ব্যক্তি মানুষের একাকীত্ব – এই বিষয়গুলো আজও মানুষকে নাড়া দেয়।
ওডিসির মূল চরিত্র ওডিসিউস একদিকে যেমন সাহসী যোদ্ধা, তেমনই বুদ্ধিমান এবং কূটকৌশলী। ইথাকায় ফেরার পথে তিনি নানা বিপদ ও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। একদিকে সাইক্লোপসের সঙ্গে তাঁর লড়াই, অন্যদিকে সাইরেনদের মোহময়ী গান থেকে নিজেকে বাঁচানো – এই সব ঘটনা ওডিসির চরিত্রকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
যুদ্ধ ফেরত যোদ্ধাদের মানসিক আঘাত নিয়েও ওডিসিতে আলোকপাত করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞানী জোনাথন শেই ২০০২ সালে ‘ওডিসিউস ইন আমেরিকা’ নামের একটি বই লেখেন, যেখানে তিনি ভিয়েতনাম ফেরত সৈন্যদের মানসিক আঘাতের সঙ্গে ওডিসির গল্পের মিল খুঁজে পান।
ওডিসির গল্পে একদিকে যেমন যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, তেমনি জীবনের প্রতি গভীর টান অনুভব করা যায়। এখানে টিকে থাকার সংগ্রাম, প্রিয়জন হারানোর বেদনা এবং বহু বছর পর নিজের ঘরে ফেরার আকুলতা – এই সবকিছুই বর্তমান।
অতএব, ওডিসির এই পুনরুজ্জীবন প্রমাণ করে যে, প্রাচীন এই মহাকাব্য আজও মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এটি শুধু একটি গল্প নয়, বরং জীবনের নানা দিক নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন।
তথ্য সূত্র: The Guardian