বিশ্বভ্রমণের দ্রুততম রেকর্ড ভাঙতে গিয়ে ভিসা জটিলতায় পড়া নাইজেরিয়ান তরুণীর অভিজ্ঞতা
বিশ্বের সব মহাদেশ দ্রুততম সময়ে ভ্রমণ করার একটি রেকর্ড গড়তে চেয়েছিলেন নাইজেরিয়ার তরুণী আলমা আসিনোবি। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
ভ্রমণের সময় ভিসা এবং বিমানবন্দরের কিছু জটিলতার কারণে তিনি এই রেকর্ডটি গড়তে ব্যর্থ হন। তবে, এর মাধ্যমে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সকলের সামনে তুলে ধরেছেন, যা হলো ‘পাসপোর্ট সুবিধা’ (Passport Privilege)।
আলমা আসিনোবি একজন ভ্রমণ বিষয়ক কনটেন্ট ক্রিয়েটর। ২৬ বছর বয়সী এই তরুণী চেয়েছিলেন, দ্রুততম সময়ে সব মহাদেশ ঘুরে আসার রেকর্ডটি ভাঙতে।
এর আগে এই রেকর্ডটি ছিল একজন আমেরিকান নাগরিকের দখলে, যিনি ৬৪ ঘণ্টায় বিশ্বভ্রমণ সম্পন্ন করেছিলেন।
আসিনোবি প্রথমে ৭৩ ঘণ্টার মধ্যে এই রেকর্ড ভাঙার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাঁর ভ্রমণে দেরি হয় এবং সবশেষে তিনি ৭১ ঘণ্টা ২৬ মিনিটে ভ্রমণ শেষ করেন।
আসুনোবি তাঁর এই বিশ্বভ্রমণের মাধ্যমে ‘পাসপোর্ট সুবিধা’ বিষয়টি সামনে আনতে চেয়েছিলেন।
হেনলি পাসপোর্ট সূচকে নাইজেরিয়ার পাসপোর্ট রয়েছে ৯২ নম্বরে, যেখানে ভিসা ছাড়া বিদেশ ভ্রমণের সুযোগের ওপর ভিত্তি করে পাসপোর্টগুলোর র্যাঙ্কিং করা হয়।
এই সূচকে ভালো অবস্থানে থাকা পাসপোর্টধারীরা খুব সহজেই বিভিন্ন দেশে যেতে পারেন, অন্যদিকে দুর্বল পাসপোর্টধারীদের অনেক বেগ পেতে হয়।
ভিসা প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিভিন্ন দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে নানান জটিলতার কারণে আসিনোবিকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
তিনি জানান, তাঁর পাসপোর্ট ‘কম সুবিধাসম্পন্ন’ হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে তাঁকে অতিরিক্ত চেকিংয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
এমনকি তিনি যখন অ্যান্টার্কটিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া ভ্রমণ করছিলেন, তখনও এই ধরনের বিড়ম্বনাগুলো তাঁকে হতাশ করেছে।
আলমা আসিনোবি ২০২০ সালের শুরুতে প্রথমবার আফ্রিকার বেনিনে ভ্রমণ করেন।
এরপর থেকে তিনি প্রায় ৩৫টি দেশ ঘুরেছেন।
ভ্রমণের সময় তিনি লক্ষ্য করেন, ভ্রমণ বিষয়ক কনটেন্ট নির্মাতারা গন্তব্যস্থলের সৌন্দর্যের দিকে বেশি মনোযোগ দেন, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর জন্য তাঁদের কী ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, সে বিষয়ে তেমন আলোচনা করেন না।
বিভিন্ন দেশের ভিসা পেতে তাঁকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হয়েছে।
তাই তিনি তাঁর সামাজিক মাধ্যমে এমন কনটেন্ট তৈরি করতে শুরু করেন, যা কম সুবিধাসম্পন্ন পাসপোর্টধারীদের জন্য সহায়ক হবে।
২০২৪ সালে, একটি ইউরোপীয় দেশে ভিসার জন্য তিনবার আবেদন করার পর অনুমোদন পাওয়ার পর তিনি এই বিষয়টি বিশ্বদরবারে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেন।
এটা এমন একটি সমস্যা, যা বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ অনুভব করে। তাঁদের ‘পাসপোর্ট সুবিধা’ নেই, কিন্তু আমরা এটি নিয়ে পর্যাপ্ত কথা বলি না। তাই আমি চেয়েছিলাম, আমার মতো পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করা কতটা কঠিন, তা বিশ্বকে দেখাই।
তিনি আরও বলেন, “এখানে অনেক কিছু ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
মানুষ বিভিন্ন মিটিং, সম্মেলনে যোগ দিতে বা পড়াশোনার জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হারায়।
আমি এমন একজনকে চিনি, যিনি তাঁর মাকে সময়মতো অন্য দেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেননি বলে হারিয়েছেন।
এটি একটি জীবন পরিবর্তনকারী ঘটনা।”
ভ্রমণ শুরুর আগে আসিনোবি অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য কিছু পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিন্তু যাত্রা শুরুর কয়েক দিন আগে তাঁর রুটের একটি দেশের ভিসা না পাওয়ায় তিনি বেশ বিপাকে পড়েন।
১৯ মার্চ তিনি অ্যান্টার্কটিকা থেকে তাঁর যাত্রা শুরু করেন।
এরপর চিলি হয়ে ডমিনিকান রিপাবলিকের পুন্টা কানায় পৌঁছান।
সেখান থেকে প্যারিসের উদ্দেশ্যে তাঁর ফ্লাইটটি যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দরের কাছে অগ্নিকাণ্ডের কারণে বাতিল হয়ে যায়।
এরপর তাঁকে স্পেনের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে তিনি সংযোগ ফ্লাইট মিস করেন এবং অবশেষে মিশরে যান।
দুবাইতে পৌঁছানোর পর তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে যাওয়ার জন্য বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি।
কর্তৃপক্ষের ভিসা পুনরায় নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল।
নাইজেরিয়ায় ফিরে এক সাক্ষাৎকারে আসিনোবি বলেন, “আমরা যে সমস্যার কথা বলতে চেয়েছি, এটি তারই একটি উদাহরণ।
আমি সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সবাই বিমানে উঠছে।
ফ্লাইট বন্ধ হওয়া পর্যন্ত আমি সেখানে ছিলাম।
বিষয়টি খুবই হৃদয়বিদারক ছিল।”
রেকর্ডটি ভাঙতে না পারলেও, ভিসা নিশ্চিত হওয়ার পর আসিনোবি সিডনি হয়ে তাঁর ভ্রমণ সম্পন্ন করেন।
তিনি বলেন, “এই পুরো প্রক্রিয়াটি আমাকে শিখিয়েছে, ভাগ্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে হয় এবং অনিশ্চয়তাকে মেনে নিতে হয়।”
পাসপোর্ট সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।
এছাড়াও, আসিনোবি একটি বিশ্ব রেকর্ড গড়তে চেয়েছিলেন।
সেটি হলো, একটি নাইজেরিয়ান পতাকায় সবচেয়ে বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ করা।
তিনি পতাকাটিতে ৬০০ জনের বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন এবং এটি নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডধারী হবেন।
আসুনোবি জানান, তিনি পাসপোর্ট সুবিধা এবং বৈষম্য নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে চান।
বিশেষ করে, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে চান, যাতে তাঁরা কোনো প্রকার বৈষম্যের শিকার না হন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন