সিনেমার ঝলমলে দুনিয়ার আড়ালে, দর্শকদের মন জয় করার এক অন্য কারিগর আছেন, যাঁদের কাজ সবসময় পর্দার আড়ালেই থেকে যায়। তাঁরা হলেন সিনেমার ট্রেলার নির্মাতা বা ট্রেলার এডিটর। সিনেমার আকর্ষণ বাড়াতে, ছবি মুক্তির আগে দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে এই মানুষগুলোর জুড়ি মেলা ভার।
সম্প্রতি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) ব্যবহার করে ট্রেলার বানানোর চেষ্টা করা হলেও, মানুষের দক্ষতার কাছে তা এখনো পর্যন্ত টেক্কা দিতে পারেনি।
কিছুদিন আগে, হলিউডের একটি স্টুডিও তাদের নতুন ছবি ‘মর্গান’-এর ট্রেলার বানানোর জন্য প্রযুক্তি জায়ান্ট আইবিএম-এর সাহায্য চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল, আইবিএম-এর তৈরি করা ‘ওয়াটসন’ নামের একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম ছবিটির বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে ট্রেলার তৈরি করুক।
সেই অনুযায়ী, সিস্টেমটিকে ১০০টি হরর ফিল্মের ট্রেলার এবং ৯০ মিনিটের ছবি ‘মর্গান’ থেকে ক্লিপ নির্বাচন করতে দেওয়া হয়। কিন্তু ফল? খুবই হতাশাজনক।
ট্রেলারটি ছিল ধীরগতির, যেন পানির নিচে দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে।
ট্রেলার তৈরি করাটা সিনেমা বানানোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি শিল্প। সিনেমার পরিচালক নন, বরং এই কাজটি করেন দক্ষ এডিটররা।
তাঁদের কাজ হলো, বড় পর্দায় সিনেমা মুক্তির আগে, দর্শকদের আকর্ষণ করার জন্য স্বল্প সময়ে ছবির মূল বিষয়গুলি তুলে ধরা। সাধারণত, ট্রেলারের সময়সীমা ২ মিনিটের বেশি হয় না।
ট্রেলার এডিটিংয়ের এই কঠিন কাজটি সম্পর্কে ক্রিয়েট অ্যাডভারটাইজিং-এর এডিটর জোয়ি কেরি বলেন, “আমার বাবা সবসময় জানতে চান, কবে আমার নাম আলো ঝলমলে অক্ষরে দেখা যাবে। আমি বলি, সম্ভবত কখনোই না।”
ছোটবেলায় তিনি কম্পিউটার ল্যাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেলার দেখতেন। তাঁর মতে, সিনেমার ট্রেলার তৈরি করা অনেকটা কবিতা লেখার মতো।
ছবি মুক্তির আগে নির্মাতারা যখন একটি কাঁচা স্ক্রিপ্ট বা অগোছালো দৃশ্য দেন, তখন এডিটররা তাঁদের নিজস্ব শৈলী ও দক্ষতার মাধ্যমে ছবির মূল বিষয় ও মেজাজ ফুটিয়ে তোলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় উপযুক্ত সঙ্গীত এবং সংলাপ।
ট্রেলার নির্মাণের এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অনেক সময় কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। পুরনো দিনের অভিজ্ঞাতা বলতে গিয়ে মাইক ডিবিবেনেটোর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি জানান, একসময় ক্লায়েন্টদের মিটিংয়ে তাঁর তৈরি করা ট্রেলার নিজের বলে চালিয়ে দিতেন তাঁর বস।
তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বিস্তার হওয়ায়, ট্রেলার নির্মাতাদের কাজের সুযোগ বেড়েছে।
নেটফ্লিক্সের মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলি এখন তাদের কন্টেন্টের প্রচারের জন্য নিয়মিত ট্রেলার তৈরি করে।
ট্রেলার তৈরির এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি এখনো পর্যন্ত মানুষের হাতেই সুরক্ষিত। যারা এই কাজটি করেন, তাঁরা তাঁদের কাজটিকে ভালোবাসেন।
তাঁদের মতে, একটি ভালো ট্রেলার হলো দর্শকদের সিনেমা হলে আসার প্রথম পদক্ষেপ। খারাপ সিনেমাকেও আকর্ষণীয় করে তোলার ক্ষমতা রাখেন একজন দক্ষ ট্রেলার এডিটর।
বর্তমানে, গোল্ডেন ট্রেলার অ্যাওয়ার্ডের মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ট্রেলার নির্মাতাদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই পুরস্কারগুলো তাঁদের কাজকে আরও উৎসাহিত করে।
তবে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই-এর মাধ্যমে ট্রেলার তৈরির চেষ্টা চললেও, মানুষের সৃজনশীলতা ও অনুভূতির কাছে তা এখনো পর্যন্ত পিছিয়ে রয়েছে।
কারণ, ভালো ট্রেলার তৈরি করতে প্রয়োজন গভীর অন্তর্দৃষ্টি, যা একজন মানুষের পক্ষেই সম্ভব।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান