ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তা প্রদানকারী জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরওয়া’র (UNRWA) সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়ায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (International Court of Justice – ICJ) তীব্র আইনি চাপের মুখে পড়েছে ইসরায়েল। হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে (ICJ) চলতি সপ্তাহে ৪০টির বেশি দেশের আইনজীবিরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সনদের লঙ্ঘনের অভিযোগ আনবেন।
তাদের মূল অভিযোগ, ইউএনআরওয়া’র কার্যক্রমের ওপর ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা জাতিসংঘের নিয়ম নীতির পরিপন্থী। গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার পর এই শুনানি নতুন মাত্রা পেয়েছে।
২রা মার্চ ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের সহায়তা প্রবেশে বাধা দেয়। মূলত, জাতিসংঘের একটি সংস্থার অধিকার খর্ব করার অভিযোগের ওপর আলোকপাত করা হবে।
ইসরায়েল অবশ্য এর আগে গত নভেম্বরে গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইউএনআরওয়ার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ ও সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। তাদের দাবি ছিল, হামাস এই সংস্থায় অনুপ্রবেশ করেছে। যদিও এই অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ইউএনআরওয়া গাজায় প্রায় ২০ লাখ মানুষকে খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে থাকে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (World Programme) জানিয়েছে, গাজার ভেতরে খাদ্য সরবরাহ করার মতো তাদের মজুত শেষ হয়ে গেছে।
ইউএনআরওয়া কমিশনার জেনারেল ফিলিপ্পে লাজ্জারিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ তৈরির অভিযোগ এনেছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইসরায়েলকে গাজায় খাদ্য সরবরাহ করতে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।
জাতিসংঘসহ ৪৫টি দেশ ও সংস্থা ইসরায়েলের পদক্ষেপের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে পরামর্শ চেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও হাঙ্গেরি সম্ভবত ইসরায়েলের পক্ষ সমর্থন করতে পারে।
ইসরায়েল লিখিতভাবে তাদের বক্তব্য জমা দিয়েছে, তবে তারা সরাসরি শুনানিতে অংশ নিচ্ছে না। জানুয়ারী, মার্চ ও জুনে আন্তর্জাতিক আদালতের (ICJ) দেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গাজায় ত্রাণ প্রবেশে বাধা দেওয়া যাবে না।
সেই নির্দেশ অমান্য করার ক্ষেত্রে এটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। জুলাই ২০২৪-এ আন্তর্জাতিক আদালত (ICJ) ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে অবৈধ ঘোষণা করে।
ইসরায়েল এই রায়গুলো মানতে রাজি হয়নি, যা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি করেছে। ফিলিস্তিনের মানবাধিকার সংস্থা ‘আল-হাক’ বলেছে, যদি ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আদালতের (ICJ) রায়কে উপেক্ষা করে, তাহলে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তাদের সদস্যপদ বাতিল করা উচিত।
তাদের মতে, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি জনগণের আস্থা এখন ঝুঁকির মুখে। ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৩৭-১২ ভোটে একটি প্রস্তাব পাস হয়। যেখানে ইসরায়েল জাতিসংঘের সনদ লঙ্ঘন করছে কিনা, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের (ICJ) পরামর্শ চাওয়া হয়।
এই প্রেক্ষাপটে আইনি লড়াই শুরু হয়েছে। ইউএনআরওয়া শুধু ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করে না, বরং গাজা, পশ্চিম তীর ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে চিকিৎসা পরিষেবা এবং স্কুলও পরিচালনা করে।
পূর্ব জেরুজালেমের ইউএনআরওয়ার ছয়টি স্কুল ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনের একটি আইনি অধিকার সংস্থা ‘আদালাহ’ এ নিয়ে আলাদাভাবে একটি আদালতে মামলা করেছে।
জাতিসংঘের আইনি দাবির সমর্থনে ১,৫০০-এর বেশি নথি উপস্থাপন করা হয়েছে, যার মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ এবং ইউএনআরওয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের ১৯৬৭ সালের কার্যক্রম বিষয়ক চুক্তিও রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) জাতিসংঘের প্রধান আদালত হিসেবে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিরোধগুলোর মীমাংসা করে থাকে এবং জাতিসংঘের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়।
জাতিসংঘের নতুন আইনি পরামর্শদাতা হিসেবে সুইডিশ আইনজীবী ও কূটনীতিক এলিনর হামারস্কজোল্ড এই মামলায় প্রতিনিধিত্ব করবেন।
আলোচনার বিষয় হলো, গত ২৮শে অক্টোবর ইসরায়েলের পার্লামেন্ট (Knesset) কর্তৃক পাস হওয়া দুটি বিল। যেখানে ইউএনআরওয়া’কে সন্ত্রাসী সংগঠনকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে এবং সংস্থাটির সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে ইউএনআরওয়া কর্মীদের ভিসা দেওয়াও বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইসরায়েল এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের সমালোচনা করে এমন এনজিওগুলোর কর্মীদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে।
২রা মার্চ, ইউএনআরওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পাশাপাশি ইসরায়েল হামাসকে দুর্বল করতে গাজায় সব ধরনের সহায়তা বন্ধ করে দেয়। ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্য ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ-এর এমন মন্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য বলে নিন্দা জানিয়েছে, যেখানে তিনি ত্রাণ সরবরাহের সঙ্গে হামাসের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ইউকে ল’য়ার্স ফর ইসরায়েল নামক একটি সংগঠন তাদের যুক্তিতে বলেছে, ইউএনআরওয়ার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে তাদের ভূখণ্ডে কার্যক্রম পরিচালনা করতে নিষেধ করার অধিকার ইসরায়েলের রয়েছে, বিশেষ করে যুদ্ধকালীন সময়ে।
তারা আরও দাবি করে, ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ইসরায়েল তার নিজস্ব পদ্ধতি বেছে নিতে পারে এবং ইউএনআরওয়ার মাধ্যমে তা করতে বাধ্য নয়।
সংস্থাটি আরও দাবি করেছে যে, ইউএনআরওয়া হামাসের সঙ্গে জড়িত কিনা, অথবা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) মতো বিকল্প সংস্থাগুলো সহায়তা সরবরাহ করতে সক্ষম কিনা – এমন বিতর্কিত বিষয়গুলো নির্ধারণের মতো ক্ষমতা বা নিরপেক্ষতা আন্তর্জাতিক আদালতের (ICJ) নেই।
মার্কিন বিচার বিভাগ সম্প্রতি জানিয়েছে, ইউএনআরওয়া এবং এর কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে দায়মুক্তি উপভোগ করে না। এর ফলে হামাসের সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ইউএনআরওয়া কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে।
ইউএনআরওয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে জাতিসংঘ সংস্থাটির ভবিষ্যৎ ভূমিকা ও আর্থিক বিষয়গুলো পর্যালোচনার জন্য ব্রিটিশ কূটনীতিক ইয়ান মার্টিনকে দায়িত্ব দিয়েছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান